নবীন

মধুরিমা, দেখো, দেখো, চাঁদের তরণীতে আজ পূর্ণতা পরিপুঞ্জিত। কত দিন ধরে এক তিথি থেকে আর-এক তিথিতে এগিয়ে এগিয়ে আসছে। নন্দনবন থেকে আলোর পারিজাত ভরে নিয়ে এল — কোন্‌ মাধুরীর মহাশ্বেতা সেই ডালি কোলে নিয়ে বসে আছে ; ক্ষণে ক্ষণে রাজহংসের ডানার মতো তার শুভ্র মেঘের বসনপ্রান্ত আকাশে এলিয়ে পড়ছে। আজ ঘুমভাঙা রাতের বাঁশিতে বেহাগের তান লাগল।

 

নিবিড় অমা-তিমির হতে

দোল লেগেছে এবার। পাওয়া আর না-পাওয়ার মাঝখানে দোল। এক প্রান্তে বিরহ, আর প্রান্তে মিলন, স্পর্শ করে দুলছে বিশ্বের হৃদয়। পরিপূর্ণ আর অপূর্ণের মাঝখানে এই দোলন। আলোতে ছায়াতে ঠেকতে ঠেকতে রূপ জাগছে — জীবন থেকে মরণে, মরণ থেকে জীবনে, অন্তর থেকে বাহিরে, আবার বাহির থেকে অন্তরে। এই দোলার তালে না মিলিয়ে চললেই রসভঙ্গ হয়। ও পাড়ার ওরা-যে দরজার আগল এঁটে বসেই রইল — হিসেবের খাতার উপর ঝুঁকে পড়েছে। একবার ওদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দোলের ডাক দাও।

ওরে গৃহবাসী, তোরা খোল্‌ দ্বার খোল্‌

কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদ-যে ধ্যানস্তিমিতলোচন পুরোহিতের মতো আকাশের বেদীতে বসে উৎসবের মন্ত্র জপ করতে লাগল। ওকে দেখাচ্ছে যেন জ্যোৎস্নাসমুদ্রের ঢেউয়ের চূড়ায় ফেনপুঞ্জের মতো — কিন্তু সে ঢেউ-যে চিত্রার্পিতবৎ স্তব্ধ। এ দিকে আজ বিশ্বের বিচলিত চিত্ত দক্ষিণের হাওয়ায় ভেসে পড়েছে, চঞ্চলের দল মেতেছে বনের শাখায়, পাখির ডানায় — আর ঐ কি একা অ‌বিচলিত হয়ে থাকবে নিবাতনিষ্কম্পমিবপ্রদীপম্‌? নিজে মাতবে না আর বিশ্বকে মাতাবে, সে কেমন হল? এর একটা যা-হয় জবাব দিয়ে দাও।

কে দেবে চাঁদ তোমায় দোলা

আজ সব ভীরুদের ভয় ভাঙানো চাই। ঐ মাধবীর দ্বিধা-যে ঘোচে না। এ দিকে আকাশে আকাশে প্রগল্‌ভতা অথচ ওরা রইল সসংকোচে ছায়ার আড়ালে। ঐ অবগুণ্ঠিতাদের সাহস দাও। বেরিয়ে পড়বার হাওয়া বইল যে — বকুলগুলো রাশি রাশি ঝরতে ঝরতে বলছে ‘ যা হয় তা হোক গে ', আমের মুকুল নির্ভয়ে বলে উঠছে ‘ দিয়ে ফেলব একেবারে শেষ পর্যন্ত '। যে পথিক আপনাকে বিলিয়ে দেবার জন্যেই পথে বেরিয়েছে তার কাছে আত্মনিবেদনের থালি উপুড় করে দিয়ে তবে তাকে আনতে পারবে নিজের আঙিনায়। কৃপণতা করে সময় বইয়ে দিলে তো চলবে না।

হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি

 

দেখতে দেখতে ভরসা বেড়ে উঠছে, তাকে পাব না তো কী। যখন দেখা দেয় না তখনো যে সাড়া দেয়। যে পথে চলে সেখানে-যে তার চলার রঙ লাগে। যে আড়ালে থাকে তার ফাঁক দিয়ে আসে তার মালার গন্ধ। দুয়ারে অন্ধকার যদি-বা চুপচাপ থাকে, আঙিনায় হাওয়াতে চলে কানাকানি। পড়তে পারি নে সব অক্ষর, কিন্তু চিঠিখানা মনের ঠিকানায় এসে পৌঁছয়। লুকিয়েই ও ধরা দেবে এমনিতরো ওর ভাবখানা।

সে কি ভাবে গোপন রবে লুকিয়ে হৃদয়-কাড়া

এইবার বেড়া ভাঙল, দুর্বার বেগে। অন্ধকারের গুহায় অগোচরে জমে উঠেছিল বন্যার উপক্রমণিকা, হঠাৎ ঝর্না ছুটে