প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
উঠে দাঁড়িয়ে বিপ্রদাসের চুলের মধ্যে আঙুল বুলোতে বুলোতে
কুমুদিনী। দাদা, তুমি আর কথা কোয়ো না। তুমি যাকে মুক্তি বল, যা জ্ঞানের দ্বারা হয়, আমাদের রক্তের মধ্যে তার বাধা। আমরা মানুষকেও জড়িয়ে থাকি, বিশ্বাসকেও ; কিছুতেই তার জট ছাড়াতে পারি নে। যতই ঘা খাই, ঘুরে ফিরে আটকা পড়ি। তোমরা অনেক জান, তাতেই তোমাদের মন ছাড়া পায় ; আমরা অনেক মানি, তাতেই আমাদের জীবনের শুন্য ভরে। তুমি যখন বুঝিয়ে দাও তখন বুঝতে পারি, হয়তো আমার ভুল আছে। কিন্তু ভুল বুঝতে পারা আর ভুল ছাড়তে পারা কি একই? লতার আঁকড়ির মতো আমাদের মমত্ব সব-কিছুকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে, সেটা ভালোই হোক আর মন্দই হোক — তার পরে আর তাকে ছাড়তে পারি নে।
বিপ্রদাস। সেইজন্যেই তো সংসারে কাপুরুষের পূজার পূজারিনীর অভাব হয় না। তারা জানবার বেলা অপবিত্রকে অপবিত্র বলেই জানে, কিন্তু মানবার বেলায় তাকে পবিত্রের মতো করেই মানে।
কুমুদিনী। কী করব দাদা, সংসারকে দুই হাতে জড়িয়ে নিতে হবে বলেই আমাদের সৃষ্টি। তাই আমরা গাছকেও আঁকড়ে ধরি, শুকনো কুটোকেও। গুরুকেও মানতে আমাদের যতক্ষণ লাগে, ভণ্ডকে মানতেও ততক্ষণ। জাল যে আমাদের নিজের ভিতরেই। দুঃখ থেকে আমাদেরকে বাঁচাবে কে? সেইজন্যেই ভাবি, দুঃখ যদি পেতেই হয়, তাকে মেনে নিয়েও তাকে ছাড়িয়ে ওঠবার উপায় করতে হবে। তাই তো মেয়েরা এত করে ধর্মকে আশ্রয় করে থাকে।
নেপথ্য থেকে
চাটুজ্জে। দাদা, এ ঘরে একবার এসো, একটা কথা বলবার আছে। দেরি হবে না।
বিপ্রদাস। এই যাই।
[ প্রস্থান
মোতির মা। কী ঠিক করলে বউরানী?
কুমুদিনী। যেতে পারব না। তা ছাড়া, আমাকে তো ফিরে যাবার অনুমতি দেন নি।
মোতির মা। স্বামী ভালোই হোক মন্দই হোক, সংসারটাকে স্বীকার করে নিতেই হবে। তা যদি একেবারে অসম্ভব হয় তা হলে মরণ ছাড়া আর গতিই নেই।
কুমুদিনী। নাহয় তাই হল। মরণের অপরাধ কী?
মোতির মা। অমন কথা বোলো না।
নবীনের প্রবেশ
কুমুদিনী। জানতুম ঠাকুরপোর আসতে বেশি দেরি হবে না।
নবীন। ন্যায়শাস্ত্রে বউরানীর দখল আছে। আগে দেখেছেন শ্রীমতী ধোঁয়াকে, তার থেকে শ্রীমান আগুনের আবির্ভাব হিসেব করতে শক্ত ঠেকে নি।
মোতির মা। বউরানী, তুমিই ওকে নাই দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছ। ও বুঝে নিয়েছে ওকে দেখলে তুমি খুশি হও, সেই দেমাকে —
নবীন। আমাকে দেখলেও খুশি হতে পারেন যিনি, তাঁর কি কম ক্ষমতা? যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনিও নিজের হাতের কাজ দেখে অনুতাপ করেন, আর যিনি আমার পাণিগ্রহণ করেছেন তাঁর মনের ভাব দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ।
কুমুদিনী। ঠাকুরপো, তোমরা দুজনে মিলে কথা-কাটাকাটি করো, তৃতীয় ব্যক্তি ছন্দোভঙ্গ করতে চায় না, আমি এখন চললুম।