প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
খানিক বাদে
দাদা, তোমার বার্লি খাবার সময় হয়েছে, এনে দিই।
বিপ্রদাস। না, সময় হয় নি। তুই বোস্। কুমু, আমার কাছে খুলে বল্, কী রকম চলছে তোদের।
কুমুদিনী। দাদা, আমি সবই ভুল বুঝেছি, আমি কিছুই জানতুম না।
কুমুর মাথায় হাত বুলিয়ে
বিপ্রদাস। আমি তোকে ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারি নি। মা থাকলে তোকে তোর শ্বশুরবাড়ির জন্যে প্রস্তুত করে দিতে পারতেন।
কুমুদিনী। আমি বরাবর কেবল তোমাদেরই জানি, এখান থেকে অন্য জায়গা যে এত বেশি তফাত তা আমি মনে করতে পারতুম না। ছেলেবেলা থেকে আমি যা-কিছু কল্পনা করেছি সব তোমাদেরই ছাঁচে। তাই মনে একটুও ভয় হয় নি। মাকে অনেক সময়ে বাবা কষ্ট দিয়েছেন জানি, কিন্তু সে ছিল দুরন্তপনা, তার আঘাত বাইরে, ভিতরে নয়। এখানে সমস্তটাই অন্তরে অন্তরে আমার যেন অপমান।
আচ্ছা, দাদা, স্বামীর 'পরে কোনোমতে মন প্রসন্ন করতে পারছি নে, এটা কি আমার পাপ?
বিপ্রদাস। কুমু, তুই তো জানিস, পাপপুণ্য সম্বন্ধে আমার মতামত শাস্ত্রের সঙ্গে মেলে না। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জীবন তার ঘটনায় ও অবস্থায় এতই ভিন্ন হতে পারে যে ভালোমন্দর সাধারণ নিয়ম অত্যন্ত পাকা করে বেঁধে দিলে অনেক সময়ে সেটা নিয়মই হয়, ধর্ম হয় না।
কুমুদিনী। যেমন মীরাবাইয়ের জীবন। মীরাবাই আপনার যথার্থ স্বামীকে অন্তরের মধ্যে পেয়েছিলেন বলেই সমাজের স্বামীকে মন থেকে ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু সংসারকে ছাড়বার সেই বড়ো অধিকার কি আমার আছে?
বিপ্রদাস। কুমু, তোর ঠাকুরকে তুই তো সমস্ত মন দিয়েই পেয়েছিস।
কুমুদিনী। এক সময়ে তাই মনে করেছিলুম। কিন্তু যখন সংকটে পড়লুম তখন দেখি, প্রাণ আমার কেমন শুকিয়ে গেছে, এত চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতে তাঁকে যেন আমার কাছে সত্য করে তুলতে পারছি নে। আমার সবচেয়ে দুঃখ সেই।
বিপ্রদাস। কুমু, মনের মধ্যে জোয়ার-ভাঁটা খেলে। কিছু ভয় করিস নে, রাত্তির মাঝে মাঝে আসে, দিন তা বলে তো মরে না। যা পেয়েছিস, তোর প্রাণের সঙ্গে তা এক হয়ে গেছে।
কুমুদিনী। সেই আশীর্বাদ করো, তাঁকে যেন না হারাই। নির্দয় তিনি দুঃখ দেন, নিজেকে দেবেন বলেই।
দাদা, আমার জন্যে ভাবিয়ে আমি তোমাকে ক্লান্ত করছি।
বিপ্রদাস। কুমু, তোর শিশুকাল থেকে তোর জন্যে ভাবা যে আমার অভ্যেস! আজ যদি তোর কথা জানা বন্ধ হয়ে যায়, তোর জন্যে ভাবতে না পাই, তা হলে শূন্য ঠেকে। সেই শূন্যতা হাতড়াতে গিয়েই তো মন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
বিপ্রদাসের পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে
কুমুদিনী। আমার জন্যে তুমি কিন্তু কিছু ভেবো না, দাদা। আমাকে যিনি রক্ষা করবেন তিনি ভিতরেই আছেন, আমার বিপদ নেই।
বিপ্রদাস। আচ্ছা, থাক্ ও-সব কথা। তোকে যেমন গান শেখাতুম, ইচ্ছে করছে তেমনি করে আজ তোকে শেখাই।
কুমুদিনী। ভাগ্যি শিখিয়েছিলে দাদা, ওতেই আমাকে বাঁচায়। কিন্তু আজ নয়, তুমি আগে একটু জোর পাও।