বাঁশরি
সেই সঙ্গে ঝাড়ু-ব্যবসায়ীর হাতটাও। এই আমরাই তোমাদের নলিনাক্ষের দল, আমাদের অপরাধ আছে ঢের, তোমাদেরও আছে বিস্তর। কসুর মাপ করতে বলি নে, ভালো করে জানতে বলি, সত্যি করে জানাতে বলি, এতে ভালোই লাগুক মন্দই লাগুক কিছুই যায় আসে না।

ক্ষিতিশ। অন্তত তোমাকে তো জেনেছি, বাঁশি। কেমন লাগছে তারও আভাস আড়চোখে কিছু কিছু পাও বোধ করি।

বাঁশরি। দেখো, সাহিত্যিক, আমাদের দলেও মানান-বেমানানের একটা নিক্তি আছে। চিটেগুড় মাখিয়ে কথাগুলোকে চট্‌চটে করে তোলা এখানে চলতি নেই। ওটাতে ঘেন্না করে। শোনো, ক্ষিতিশ, আর-একবার তোমাকে স্পষ্ট করে বলি।

ক্ষিতিশ। এত অধিক স্পষ্ট তোমার কথা যে, যত বুঝি তার চেয়ে বাজে বেশি।

বাঁশরি। তা হোক, শোনো। অশ্বত্থামার ছেলেবেলাকার গল্প পড়েছ। ধনীর ছেলেকে দুধ খেতে দেখে যখন সে কান্না ধরল, তাকে পিটুলি গুলে খেতে দেওয়া হল, দু হাত তুলে নাচতে লাগল দুধ খেয়েছি বলে।

ক্ষিতিশ। বুঝেছি, আর বলতে হবে না। অর্থাৎ, আমার লেখায় পিটুলি-গোলা জল খাইয়ে পাঠক শিশুদের নাচাচ্ছি।

বাঁশরি। বানিয়ে-তোলা লেখা তোমার, বই প’ড়ে লেখা। জীবনে যার সত্যের পরিচয় আছে তার অমন লেখা বিস্বাদ লাগে।

ক্ষিতিশ। সত্যের পরিচয় আছে তোমার?

বাঁশরি। হাঁ আছে, দুঃখ এই, লেখবার শক্তি নেই। তার চেয়ে দুঃখের কথা –লেখবার শক্তি আছে তোমার, কিন্তু নেই সত্যের পরিচয়। আমি চাই, তুমি স্পষ্ট জানতে শেখ যেমন প্রত্যক্ষ করে আমি জেনেছি, সাঁচ্চা করে লিখতে শেখ। যাতে মনে হবে, আমারই মন প্রাণ যেন তোমার কলমের মুখে ফুটে পড়ছে।

ক্ষিতিশ। জানার কথা তো বললে, জানবার পদ্ধতিটা কী।

বাঁশরি। পদ্ধতিটা শুরু হোক আজকের এই পার্টিতে। এখানকার এই জগৎটার কাছ থেকে সেই পরিমাণে তুমি দূরে আছ, যাতে এর সমস্তটাকে নির্লিপ্ত হয়ে দেখা সম্ভব।

ক্ষিতিশ। আচ্ছা, তা হলে এই পার্টিটার একটা সরল ব্যাখ্যা দাও, একটা সিনপ্‌‍সিস।

বাঁশরি। তবে শোনো। এক পক্ষে এই বাড়ির মেয়ে, নাম সুষমা সেন। পুরুষ-মাত্রেরই মত এই যে, ওর যোগ্যপাত্র জগতে নেই নিজে ছাড়া। উদ্ধত যুবকদের মধ্যে মাঝে মাঝে এমনতরো আস্তিন-গোটানো ভঙ্গী দেখি যাতে বোঝা যায়, আইন-আদালত না থাকলে ওকে নিয়ে লোকক্ষয়কর কাণ্ড ঘটত। অপর পক্ষে শম্ভুগড়ের রাজা সোমশংকর। মেয়েরা তার সম্বন্ধে কী কানাকানি করে বলব না, কারণ আমিও স্ত্রী জাতিরই অন্তর্গত। আজকের পার্টি এঁদের দোঁহাকার এন্‌‍গেজ্‌‍মেণ্ট নিয়ে।

ক্ষিতিশ। দুজন মানুষের ঠিকানা পাওয়া গেল। দুই সংখ্যাটা গড়ায় এসে সুশীতল গার্হস্থ্যে। তিন সংখ্যাটা নারদ, পাকিয়ে তোলে জটা, ঘটিয়ে তোলে তাপজনক নাট্য। এর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি কোথাও আছে নিশ্চয়, নইলে সাহিত্যিকের প্রলোভন কোথায়।

বাঁশরি। আছে তৃতীয় ব্যক্তি, সেই হয়তো প্রধান ব্যক্তি। লোকে তাকে ডাকে পুরন্দরসন্ন্যাসী। পিতৃদত্ত নামটার সন্ধান মেলে না। কেউ দেখেছে তাকে কুম্ভমেলায়, কেউ দেখেছে গারো পাহাড়ে ভালুক-শিকারে। কেউ বলে, ও য়ুরোপে অনেককাল ছিল। সুষমাকে কলেজের পড়া পড়িয়েছে আপন ইচ্ছায়। অবশেষে ঘটিয়েছে এই সম্বন্ধ। সুষমার মা বললেন–অনুষ্ঠানটা হোক ব্রাক্ষ্মসমাজের কাউকে দিয়ে, সুষমা জেদ ধরলে একমাত্র পুরন্দর ছাড়া আর-কাউকে দিয়ে চলবে না। চতুর্দিকের আবহাওয়াটার কথা যদি জিজ্ঞাসা কর, বলব, কোনো-একটা জায়গায় ডিপ্রেশন ঘটেছে। গতিকটা ঝোড়ো রকমের; বাদলা কোনো-না-কোনো পাড়ায় নেমেছে, বৃষ্টিপাত হয়তো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বাস্‌, আর নয়।

ক্ষিতিশ। ঐ যাঃ, এই দেখো আমার এণ্ডির চাদরটাতে মস্ত একটা কালির দাগ।