শ্রাবণগাথা
তো কান্না নয়, ওতে আছে ঐরাবতের গর্জন, আছে উচ্চৈঃশ্রবার দৌড়।

নটরাজ। আছে বৈকি। এসো তবে বিদ্যুন্ময়ী, শ্রাবণ যে স্বয়ং বজ্রপাণি মহেন্দ্রের সভাসদ্‌, নৃত্যে সুরে তোমরা তার প্রমাণ করে দাও।

নটরাজ। ওহে ওস্তাদ, তোমার গানের পিছনে পিছনে ঐ যে দলে দলে মেঘ এসে জুটল। গরজত বরখত চমকত বিজুরী। দুই পক্ষের পাল্লা চলুক। সুরে তালে কথায়, আর মেঘে বিদ্যুতে ঝড়ে।

        পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণগন-অঙ্গনে।

        মন রে আমার, উধাও হয়ে নিরুদ্দেশের সঙ্গ নে।

দিক্-হারানো দুঃসাহসে সকল বাঁধন পড়ুক খসে;

কিসের বাধা। ঘরের কোণে শাসনসীমালঙ্ঘনে।

        বেদনা তোর বিজুলশিখা জ্বলুক অন্তরে,

        সর্বনাশের করিস সাধন বজ্রমন্তরে।

অজানাতে করবি গাহন, ঝড় সে হবে পথের বাহন;

শেষ করে দিস আপ্‌নারে তুই প্রলয়রাতের ক্রন্দনে॥

সভাকবি। ঐ রে! ঘুরে ফিরে আবার এসে পড়ল— সেই অজানা, সেই নিরুদ্দেশের পিছনে-ছোটা পাগলামি।

নটরাজ। উজ্জয়িনীর সভাকবিরও ছিল ঐ পাগলামি। মেঘ দেখলেই তাঁকেও পেয়ে বসত অকারণ উৎকণ্ঠা; তিনি বলেছেন, মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ— এখানকার সভাকবি কি তার প্রতিবাদ করবেন।

সভাকবি। এত বড়ো সাহস নেই আমার। কালিদাসকে নমস্কার ক’রে যথাসাধ্য চেষ্টা করব মেঘ-দেখা হাহুতাশটাকে মনে আনতে।

নটরাজ। আচ্ছা, তবে থাক্‌, কিছুক্ষণ হাহুতাশ, এখন অন্য কথা পাড়া যাক। মহারাজ, সব চেয়ে যারা ছোটো, উৎসবে সব চেয়ে সত্য তাদেরই বাণী। বড়ো বড়ো শাল তাল তমালের কথাই কবিরা বড়ো করে বলেন— যে কচি পাতাগুলি বন জুড়ে কোলাহল করে তাদের জন্যে স্থান রাখেন অল্পই।

রাজা। সত্য বলেছ, নটরাজ। ক্রিয়াকর্মের দিনে পাড়ার বুড়ো বুড়ো কর্তারা ভাঙা গলায় হাঁকডাক করে, কিন্তু উৎসব জমে ওঠে শিশুদের কলরবে।

নটরাজ। ঐ কথাটাই বলতে যাচ্ছিলুম। কিশলয়িনী, এসো তুমি শ্রাবণের আসরে।

                ওরা     অকারণে চঞ্চল;

          ডালে ডালে দোলে বায়ু হিল্লোলে

                নব পল্লবদল।

          বাতাসে বাতাসে প্রাণভরা বাণী

          শুনিতে পেয়েছে কখন কী জানি,

      মর্মরতানে দিকে দিকে আনে কৈশোর-কোলাহল।

ওরা   কান পেতে শোনে গগনে গগনে মেঘে মেঘে কানাকানি,

                বনে বনে জানাজানি।