শ্রাবণগাথা

নটরাজ। বরমপি বিরহো ন সঙ্গমস্তস্যা। পেটভরা মিলনে সুর চাপা পড়ে, একটু ক্ষুধা বাকি রাখা চাই, কবিরাজরা এমন কথা বলে থাকেন। আচ্ছা, তবে মিলনতরীর সারিগান বিরহবন্যার ও পার থেকে আসুক সজল হাওয়ায়।

ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে

বাদল-বাতাস মাতে মালতীর গন্ধে।

উৎসবসভা-মাঝে           শ্রাবণের বীণা বাজে,

শিহরে শ্যামলে মাটি প্রাণের আনন্দে।

দুই কূল আকুলিয়া অধীর বিভঙ্গে

নাচন উঠিল জেগে নদীর তরঙ্গে।

কাঁপিছে বনের হিয়া           বরষনে মুখরিয়া,

বিজলি ঝলিয়া উঠে নবঘনমন্দ্রে॥

রাজা। এ গানটাতে একটু উৎসাহ আছে। দেখছি, তোমার মৃদঙ্গওয়ালার হাত দুটো অস্থির হয়ে উঠেছে—ওকে একটু কাজ দাও।

নটরাজ। এবার তা হলে একটা অশ্রুত গীতচ্ছন্দের মুর্তি দেখা যাক।

সভাকবি। শুনলেন ভাষাটা! অশ্রুত গীত। নিরন্ন ভোজের আয়োজন!

রাজা। দোষ দিয়ো না, যাদের যেমন রীতি। তোমাদের নিমন্ত্রণে আমিষের প্রাচুর্য।

সভাকবি। আজ্ঞা হাঁ মহারাজ, আমরা আধুনিক, আমিষলোলুপ।

নটরাজ। শ্যামলিয়া, দেহভঙ্গির নিঃশব্দ গানের জন্য অপেক্ষা করছি।

নাচ

রাজা। অতি উত্তম। শূন্যকে পূর্ণ করেছ তুমি। এই নাও পুরস্কার। নটরাজ, তোমাদের পালাগানে একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখেছি, এতে বিরহের অংশটাই যেন বেশি। তাতে ওজন ঠিক থাকে না।

নটরাজ। মহারাজ, রসের ওজন আয়তনে নয়। সমস্ত গাছ এক দিকে, একটিমাত্র ফুল এক দিকে—তাতেও ওজন থাকে। অসীম অন্ধকার এক দিকে, একটি তারা একদিকে—তাতেও ওজনের ভুল হয় না। বিরহের সরোবর হোক-না অকূল, তারই মধ্যে একটিমাত্র মিলনের পদ্মই যথেষ্ট।

সভাকবি। এঁদের দেশের লোক বাচালের সেরা, কথায় পেরে উঠবেন না। আমি বলি সন্ধি করা যাক—ক্ষণকালের জন্য মিলনও ক্ষান্ত দিক, বিরহও চুপ মেরে থাক্‌। শ্রাবণ তো মেয়ে নয় মহারাজ, সে পুরুষ, ওঁর গানে সেই পুরুষের মূর্তি দেখিয়ে দিন্‌-না।

নটরাজ। ভালো বলেছ, কবি। তবে এসো উগ্রসেন, উন্মত্তকে বাঁধো কঠিন ছন্দে, বজ্রকে মঞ্জীর ক’রে নাচুক ভৈরবের অনুচর।

হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরুগুরু,

ঘন মেঘের ভুরু কুটিল কুঞ্চিত।

হল রোমাঞ্চিত বনবনান্তর,

দুলিল চঞ্চল বক্ষোহিন্দোলে

মিলনস্বপ্নে সে কোন্‌ অতিথি রে।