শ্রাবণগাথা

সভাকবি। আমরা সহ্য করব ওঁদের স্বরবর্ষণ, মহাবীর ভীষ্মের মতো।

নটরাজ। ধরণীর তপস্যা সার্থক হয়েছে, প্রণতি। রুদ্র আজ বন্ধুরূপ ধরেছেন, তাঁর তৃতীয় নেত্রের জলদগ্নি দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেছে শ্যামল জটাভার—প্রসন্ন তাঁর মুখ। প্রথমে সেই বন্ধুদর্শনের আনন্দকে আজ মুখরিত করো।

তপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে।

হৃদয় আমার, শ্যামল বঁধুর করুণ স্পর্শ নে।

অঝোর-ঝরন শ্রাবণজলে

তিমিরমেদুর বনাঞ্চলে

ফুটুক সোনার কদম্বফুল নিবিড় হর্ষণে।

ভরুক গগন, ভরুক কানন, ভরুক নিখিল ধরা,

দেখুক ভুবন মিলনস্বপন মধুর বেদনা-ভরা।

পরান-ভরানো ঘনছায়াজাল

বাহির আকাশ করুক আড়াল,

নয়ন ভুলুক, বিজুলি ঝলুক পরম দর্শনে।

      —

নমো নমো নমো করুণাঘন নমো হে।

নয়নস্নিগ্ধ অমৃতাঞ্জনপরশে,

জীবন পুর্ণ সুধারসবরষে,

তব দর্শনধনসার্থক মন হে,

অকৃপণবর্ষণ করুণাঘন হে।

নমো হে নমো হে॥

সভাকবি। নটরাজ, মহারাণী-মাতার কল্যাণে সেদিন রাজবাড়ি থেকে কিছু ভোজ্যপানীয় সংগ্রহ করে নিয়ে আসছিলেম গৃহিণীর ভাণ্ডার-অভিমুখে। মধ্যপথে বাহনটা পড়ল উঁচট খেয়ে, ছড়িয়ে পড়ল মোদক মিষ্টান্ন পথের পাঁকে, গড়িয়ে পড়ল পায়সান্ন ভাঙা হাঁড়ি থেকে নালার মধ্যে। তখন মুষলধারে বর্ষণ হচ্ছে—নৈবেদ্যটা শ্রাবণ স্বয়ং নিয়ে গেলেন ভাসিয়ে। তোমাদের এই প্রণামটাও দেখি সেইরকম। খুবই ছড়িয়েছ বটে, কিন্তু পৌছল কোথায় ভেবে পাচ্ছি নে।

নটরাজ। কবিবর, আমাদের প্রণামের রস তোমার হাঁড়িভাঙা পায়েসের রস নয়— ওকে নষ্ট করতে পারবে না কোনো পাঁকের অপদেবতা; সুরের পাত্রে রইল ও চিরকালের মতো, চিরকালের শ্যামল বঁধুর ভোগে বর্ষে বর্ষে ওর অক্ষয় উৎসর্গ।

রাজা। কিছু মনে কোরো না নটরাজ, আমাদের সভাকবি দুঃসহ আধুনিক। হাঁড়িভাঙা পায়েসের রস পাঁকে গড়ালে উনি সেটাকে নিয়ে চৌরপঙ্কশতক রচনা করতে পারেন, কিন্তু তৃপ্তি পান না সেই রসে যার সঙ্গে না আছে জঠরের যোগ, না আছে ভাণ্ডারের। তোমার কাজ অসংকোচে করে যাও, এখানে অন্য শ্রোতাও আছে।

নটরাজ। বনমালিনী, এবার তবে বর্ষাধারাস্নানের আমন্ত্রণ ঘোষণা করে দাও নূপুরের ঝংকারে, নৃত্যের হিল্লোলে। চেয়ে দেখো, শ্রাবণঘনশ্যামলার সিক্ত বেণীবন্ধন দিগন্তে স্খলিত, তার ছায়াবসনাঞ্চল প্রসারিত ঐ তমালতালীবনশ্রেণীর শিখরে শিখরে।