প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
তিনি যে অতি বড়ো লোক তখন আমরা তাহা বুঝিতাম না। এখনকার মতো তখন সংবাদপত্র, সভাসমিতি, সমালোচনা, প্রভৃতি ছিল না, সুতরাং মানুষ লোকচক্ষুর আড়ালে বাড়িতে পাইত। শকুনি যেমন শবদেহ লইয়া টানা-হেঁচড়া করে, এখন জীবিতদের লইয়া সংবাদপত্র সেইরূপ করে। রাজনারায়ণবাবুর আমলে ‘সোমপ্রকাশ’ প্রভৃতি কাগজ ছিল বটে, তবে ওই-সকল কাগজ সংযত ছিল। অন্তত এখন যেমন কাগজে সত্যমিথ্যায় জোড়াতাড়া দিয়া এক-একটা লোকের সম্বন্ধে লেখা হয় তখন তেমন হইত না। তখন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকিবার সুযোগ ছিল। এইরূপভাবে রাজনারায়ণবাবু মহৎ হইয়াছিলেন বলিয়া লোকের মধ্যে তিনি তেমন প্রসিদ্ধিলাভ করেন নাই। এমন-কি অমন মহৎ ব্যক্তির নামও হয়তো এইকালে অনেকে জানেন না।
রাজনারায়ণবাবু দিবারাত্র কার্য করিতেন। ভাঙাগড়ার এক বিশেষ যুগে তিনি জন্মলাভ করিয়াছিলেন। সকল-প্রকার দেশের কার্যের সহিত তাঁহার যোগ ছিল। আমার পূর্বে যাঁহারা বলিয়াছিলেন তাঁহাদের মুখে আপনারা শুনিয়াছেন যে, স্বদেশী মেলা, এবং নানাপ্রকার সভার সহিত তাঁহার যোগ ছিল; কিন্তু তবু তাঁহার মুখে কোনো চাঞ্চল্য ছিল না।
জাপান-যাত্রার সময়ে দেখিয়াছি, অতি ভীষণ ঝটিকার মধ্যে জাপানি জাহাজের কর্ণধার আমার সহিত তখনকার বায়ুর গতির বেগ ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা করিতেছিলেন। এত বড়ো প্রবল ঝড় সাধারনত হয় না। ওই ঝড় সম্বন্ধে তাঁহার মনে কোনো চিন্তা ছিল না তাহা নহে; কিন্তু সকল কার্যের ব্যবস্থা, এমন- কি জাহাজ জলমগ্ন হইলে যাত্রীরা যাহা পরিয়া জলে ঝাপ দিবে, তাহার আয়োজন হইয়াছিল; তবু তিনি আমার সহিত গল্প করিতেছিলেন।
রাজনারায়ণবাবু তখনকার সেই প্রবল ভাঙাগড়ার যুগে সকল কার্যের মধ্যে থাকিয়াও আমার মতো বালকের সহিত মেলামেলা কর্তব্য মনে করিতেন। শিশুদের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা ছিল।
ইহা যে তিনি কেবল কর্তব্যবুদ্ধিতে করিতেন তাহা নহে, ওই কর্তব্যবুদ্ধির পশ্চাতে তাঁহার একটা পরিপূর্ণ জীবন রহিয়াছে। কর্তব্যবুদ্ধি অনেক সময়ে সংকীর্ণভাবে কার্য করিয়া থাকে। রাজনারায়ণবাবুর কর্তব্যবুদ্ধি তেমন সংকীর্ণ নহে। তিনি আমার পিতার সকল কার্যের সঙ্গী ছিলেন; আমার অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ আমার অপেক্ষা বয়সে অনেক বড়ো, তিনি তাঁহার সুহৃদ ছিলেন; আবার আমার মতো শিশুরও তিনি বয়স্য ছিলেন। সকলের সহিত মিশিবার জন্য যেমন সরসতা দরকার তাহা তাঁহার ছিল।
উপর হইতে যে বারিবর্ষ্ণ হয় উহাই পৃথিবীর সজীবতা রক্ষা করে তাহা নহে, পৃথিবীর ভিতরেও নিত্যপ্রবাহিত রসের ধারা আছে। কর্তব্যের চাপে নহে, আনন্দেই সংসারের সৃষ্টি হইতেছে। উপনিষদে আছে আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে, অর্থাৎ আনন্দ হইতে জগৎ সৃষ্টি হইয়াছে। রাজনারায়ণবাবুর জীবনে এই আনন্দরসের প্রাচুর্য ছিল।
যাহাকে কিছু উৎপন্ন করিতে হয় তাহার নিজের পদতলের ভূমির উপর শ্রদ্ধা থাকা চাই। এই ভূমি বালুকাময়, এই ভূমি অসার, এইরূপ যিনি মনে করেন তাঁহার ভূমিকর্ষণ ও শসোৎপাদনে মনোযোগ হয় না।
এই দেশের প্রতি রাজনারায়ণবাবুর শ্রদ্ধা ছিল; শ্রদ্ধা ছিল বলিয়াই তিনি এই দেশের মঙ্গলের জন্য বিবিধ কার্য করিতে পারিয়াছিলেন।
তাঁহার সময়ের শিক্ষিতেরা দেশকে ভুলিয়া বিদেশী ইতিহাসকে উপাড়িয়া এই দেশে আনিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহারা