বিজন চিন্তা : কল্পনা
এই মহাকল্লোলময় মহানগরের এক প্রান্তে একখানি পর্ণকুটিরে আমার বাস। আমি সংসারী নহি, কেননা আমার সংসার নাই—আমি বিধবা, আমার আদর করিবার স্বামী নাই, সান্ত্বনা করিবার বন্ধু নাই, স্নেহ কিনিবার বিভব নাই, যত্ন লাভের সামর্থ্য নাই; ছিন্ন তৃণবৎ আমি সংসার-সাগর-স্রোতে একলাই ভাসিতেছি, একলাই উঠিতেছি, একলাই পড়িতেছি। ভিক্ষা ভিন্ন আমার আর উপায় নাই। ভিক্ষা করিতে গিয়া আমি নানা প্রকার লোক দেখিতে পাই—তাহাদের নানাবিধ ভাবভঙ্গি আলোচনা করি—বিদ্বান মূর্খদের দলে দাঁড়াইয়া তাহাদের মতামত শুনি, মনে মনে হাসি কখনো বা কাঁদি, আবার বাড়ি আসিয়া সেই-সব কথা লিখি। এইরূপে কোনোপ্রকারে সময় কাটাই। আমি এখন খুব স্বাধীন, অথচ স্বাধীনতায় সুখ পাই না। মনের ভিতর যেন কেমন একটা হু হু করিতে থাকে। প্রাতঃকাল হইতে রাত্রিকাল পর্যন্ত কত লোকই দেখিতেছি কিন্তু আমি কেমন আছি, বা আমি কে, এ কথা জিজ্ঞাসা করিবার একজনকে দেখিতে পাই না—সুতরাং লক্ষ লক্ষ মানবের মধ্যে থাকিয়াও আমার পর্ণকুটিরের বিজনতা কখনোই ভঙ্গ হয় না। আমি আপনি হাসি, আপনি কাঁদি, আপনি ভাবি। মনে করিয়াছিলাম যে সংসারের শৃঙ্খল ছেদ করিয়া এই বিজন কুটিরে মনের সুখে বাস করিব। মনে করিয়াছিলাম যে, যখন কাহারো সঙ্গে আর সম্পর্ক নাই তখন কিসের উদ্‌বেগ, যখন আমি আর মোহের অধীন নহি তখন আর কিসের যাতনা, যখন মায়ায় আবদ্ধ নহি তখন কিসের ভাবনা, কিন্তু অপরিমিত স্বাধীনতাতেই কি সুখ?—অপরিমিত স্বাধীনতাতে রাজ্য উচ্ছিন্ন হয়, সমাজ উচ্ছৃঙ্খল হয়, ব্রক্ষ্মান্ড বিপ্লবস্থ হয়। লোকে যেমন ভাষা কথায় বলিয়া থাকে—‘বড়ো হবে তো ছোটো হও’ তেমনি স্বাধীনতা সম্বন্ধে এ কথাও বলা যাইতে পারে যে, স্বাধীন হবে তো পরাধীন হও। সমস্ত ব্রক্ষ্মান্ডপক্ষে যে কথা স্থির সিদ্ধান্তপ্রায়, সমস্ত সমাজ, সমস্ত রাজ্যপক্ষে যে কথা স্থির সিদ্ধান্তপ্রায়, প্রত্যেক মনুষ্যের পক্ষে কেনই বা তাহা অপ্রতিষ্ঠ হইবে? সমস্ত বাহ্য প্রকৃতির নিয়ম পরাধীনতা; সমস্ত বাহ্য অন্তঃপ্রকৃতির নিয়মও পরাধীনতা; সমস্ত বাহ্য প্রকৃতি এক আকর্ষণের অধীন হইয়া চলিতেছে, সমস্ত অন্তঃপ্রকৃতিও এক আকর্ষণের অধীন হইয়া চলিতেছে। যে লোকে বলিয়াছেন—

‘আমার হৃদয় আমারি হৃদয়
বেচি নি তো তাহা কাহারো কাছে’।
তিনি মিথ্যা কথা কহিয়াছেন। এরূপ গর্বিত আস্ফালন কোনো হৃদয়সম্পন্ন মানুষের কন্ঠ হইতে নিঃসৃত হইতে পারে না। আমার হৃদয় আছে যখনই ভাবিতে পারিলাম তখন ইহাও নিশ্চয় যে সে হৃদয় পরাধীন—হয় কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয় কোনো বস্তুবিশেষের। কিন্তু এই প্রকার পরাধীনতা কি বিষাদের? এই পরাধীনতার শৃঙ্খল কি মানুষ মাকড়শার মতো আপনা হইতেই উদ্‌গত করিয়া আপনিই তাহাতে বিজড়িত হইতে চাহে না? এই পরাধীনতার বীজ মানবহৃদয়ে নিহিত থাকিলেও মানুষে আপনি কি প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া তাহা অঙ্কুরিত করিতে—তাহা বৃক্ষে পরিণত করিতে চাহে না? পরিণামে সেই বৃক্ষে বিষময় ফলই উৎপন্ন হোক আর সুধাময় ফলই উৎপন্ন হোক, সে বৃক্ষকে ফলিত করিতে কি মানুষে কোনো প্রকার ত্যাগ স্বীকার করিতে শিথিলপ্রযত্ন হয়? মানবহৃদয়ের ইতিবৃত্ত পড়িলে কখনোই তাহা বোধ হইবে না। কিন্তু কিসের মোহে মুগ্ধ হইয়া মানুষে এইরূপ স্ব-নির্মিত তরঙ্গে তরঙ্গিত হইতে থাকে? সে কেবল কল্পনার মোহে! মহাকবি শেক‍্‌স‍্‌পিয়র বলিয়াছেন বটে যে, কবি প্রণয়ী আর উন্মাদগ্রস্ত ইহারাই কল্পনাপ্রধান, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বাহ্যপ্রকৃতি যেমন এক মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে পরিচালিত হইতেছে, মানবহৃদয়ও সেইপ্রকার কেবল কল্পনা-প্রভাবেই পরিচালিত হইতেছে। ম্যাডেগ্যাস্কর দ্বীপের অসভ্য জাতিরা যখন তাহাদের বিকট-দর্শন প্রস্তরময় দেবমূর্তির সন্মুখে দন্ডায়মান হইয়া কাতর হৃদয়ে বর প্রার্থনা করে, হিন্দুরা যখন বিজয়া-দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন করিয়া ভগ্নহৃদয় হয়, খৃষ্টানেরা যখন কুমারীপুত্র যিশুখৃস্টকে আপনাদের পাপের