বিজন চিন্তা : কল্পনা
ভার বহন করিতে প্রার্থনা করে, তখন কি কল্পনার মোহন প্রভাব প্রতীত হয় না? ধনোপার্জন, বিদ্যাশিক্ষা, পুত্রপালন, এ সকলেরই গভীরতম মূল প্রদেশে কল্পনা-শক্তিই প্রচ্ছন্ন ভাবে বিরাজিত থাকে। কেহ কেহ বলিতে পারেন যে, এ-সকল কার্যে আশাই আমাদিগকে প্রবর্তিত করে, কিন্তু যদি আশানুরূপ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের কাচ কল্পনার দ্বারা সুমার্জিত ও সুরঞ্জিত না হইত, তাহা হইলে আশার উত্তজনায় কেহই উত্তেজিত হইত না।

কল্পনার মহান প্রভাব এখানেই ক্ষান্ত নহে, শুদ্ধ যে আমরা ইহার প্রভাবে সুন্দর সামগ্রীকে সুন্দরতর দেখি এমন নহে, সুদ্ধ যে আমরা ইহার প্রভাবে সকল-প্রকার বিঘ্ন ব্যবধান অতিক্রম করিয়া মরুভূমিতে থাকিয়াও নন্দনকাননের শোভা সন্দর্শন করি এমন নহে, কিন্তু ইহার প্রভাবে আমরা সকল-প্রকার সুন্দর পদার্থ হইতে তাহাদের সুন্দরতম অংশগুলি গ্রহণ করিয়া অশেষবিধ তিলোত্তমা বা প্যান্ডোরা সৃজন করিতে পারি।

সত্য বটে যে কল্পনা যেমন সুখের কারণ, আবার কল্পনা তেমনি দুঃখের কারণ, সত্য বটে যে, কল্পনা-প্রভাবে আমরা বৈজয়ন্তধামকেও শ্মশানের চিতা আকারে রূপান্তরিত করিতে পারি, সত্য বটে যে কল্পনা প্রভাবে আমরা মিলটন-বর্ণিত দেবতুল্য মানবমুখেও বায়রন-বর্ণিত পিশাচের প্রতিকৃতি উপলব্ধি করিতে পারি এবং মার্কন্ডেয় চন্ডীর দেবী-অংশভূতা নারীজাতিকেও হ্যামলেটের মতো অসতীত্বরূপ দুর্বলতার নামান্তর মনে করিতে পারি, কিন্তু তাহা প্রকৃত প্রস্তাবে কল্পনার দোষ নহে, তাহা আমাদেরই দোষ। কল্পনাকে সংযত করা, শিক্ষিত করা ও বিবেকবুদ্ধির অধীন করা আমাদের উপরেই নির্ভর করিতেছে। কল্পনাই আমাদের কার্যের প্রবর্তক, ভাবনার প্রকৃত উত্তেজক, আশার চিত্রকর, সুখের আত্মা।

কল্পনার তারতম্যে আমাদের সুখেরও তারতম্য ঘটিয়া থাকে। এই যে সমস্ত বিশ্বকান্ড আমাদের সন্মুখে প্রসারিত রহিয়াছে, এই যে অনন্ত শোভার ভান্ডার আমাদের সম্মুখে মুক্তদ্বার রহিয়াছে—ইহার কি কোনো রসই আমরা অনুভব করিতে পারিতাম, কোনো ভাবই কি গ্রহণ করিতে পারিতাম, কোনো শোভাই কি উপভোগ করিতে পারিতাম যদি কল্পনার দ্বারা আমাদের দিব্য চক্ষু না পরিস্ফুটিত হইত? পৃথিবী তো মৃত্তিকাময়, সমুদ্র তো সলিলময়, সূর্য তো অগ্নিময় মাত্র—তবে কেন পৃথিবীর শোভা সন্দর্শনে হৃদয় দ্রবীভূত হয়, সাগরের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়েও উচ্ছ্বসিত হইতে থাকে এবং সূর্যের অভ্যুদয়ে হৃদয়ও এক নূতন জীবনে সজ্ঞীবিত হইয়া উঠে।

কল্পনা বিরহিত হইলে কে আর শেক‍্‌স‍্‌পিয়রের মতন বৃক্ষ-পল্লবের অস্ফুট ভাষা বুঝিতে পারিত, প্রবাহমান নদীবক্ষে গ্রন্থ পাঠ করিতে পারিত, প্রস্তর-খন্ডে উপদেশ গ্রহণ করিতে পারিত ও সমস্ত ব্রক্ষ্মান্ডময় মঙ্গলভাব উপলব্ধি করিতে পারিত? কল্পনায় সকল দ্রব্যকে হৃদয়ের উপভোগের মতো করিয়া লওয়া যায়—

The meanest floweret of the vale,

The simplest note that swells the gale,

The common sun, the air, the skies,

To him are sweetest Paradise.