দ্বিতীয় ভাগ
একাদশ পাঠ

ভক্তরামের নৌকো শক্ত কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি। ভক্তরাম সেই নৌকো সস্তা দামে বিক্রি করে। শক্তিনাথবাবু কিনে নেন। শক্তিনাথ আর মুক্তিনাথ দুই ভাই। যে-পাড়ায় থাকেন তার নাম জেলেবস্তি। তাঁর বাড়ি খুব মস্ত। সামনে নদী, পিছনে বড়ো রাস্তা। তাঁর দরোয়ান শক্তু সিং আর আক্রম মিশ্র রোজ সকালে কুস্তি করে। শক্তিনাথবাবুর চাকরের নাম অক্রূর। তাঁর বড়ো ছেলের নাম বিক্রম। ছোটো ছেলের নাম শত্রুনাথ। শক্তিবাবু তাঁর নৌকো লাল রঙ ক’রে নিলেন। তার নাম দিলেন রক্তজবা। তিনি মাঝে মাঝে নৌকোয় ক’রে কখনো তিস্তা নদীতে কখনো আত্রাই নদীতে কখনো ইচ্ছামতীতে বেড়াতে যান। একদিন অঘ্রান মাসে পত্র পেলেন, বিপ্রগ্রামে বাঘ এসেছে। শিকারে যাত্রা করলেন। সেদিন শুক্রবার। শুক্লপক্ষের চন্দ্র সবে অস্ত গেচে। আক্রম বন্দুক নিয়ে চললো। আরো দুটো বল্লম ছিল। সিন্দুকে ছিল গুলি বারুদ। নদীতে প্রবল স্রোত। বেলা যখন দুই প্রহর, নৌকো নন্দগ্রামে পৌঁছলো। রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করছে। এক ভদ্রলোক খবর দিলেন, কাছেই বন্দীপুরের বন, সেখানে আছে বাঘ।

শক্তিবাবু আর আক্রম বাঘ খুঁজতে নামলেন। জঙ্গল ঘন হয়ে এলো। ঘোর অন্ধকার। কিছু দূরে গিয়ে দেখেন, এক পোড়ো মন্দির। জনপ্রাণী নেই। শক্তিবাবু বললেন, এইখানে একটু বিশ্রাম করি। সঙ্গে ছিল লুচি, আলুর দম আর পাঁঠার মাংস। তাই খেলেন। আক্রম খেলো চাট‍্‌নি দিয়ে রুটি। তখন বেলা প’ড়ে আসছে। গাছের ফাঁক দিয়ে বাঁকা হয়ে রৌদ্র পড়ে। প্রকাণ্ড অর্জুন গাছের উপর কতকগুলো বাঁদর; তাদের লম্বা ল্যাজ ঝুলছে। শক্তিবাবু কিছু দূরে গিয়ে দেখলেন, একটা ছোটো সোঁতা। তাতে এক হাঁটুর বেশি জল হবে না। তার ধারে বালি। সেই বালির উপর বড়ো বড়ো থাবার দাগ। নিশ্চয় বাঘের থাবা। শক্তিবাবু ভাবতে লাগলেন, কী করা কর্তব্য। অঘ্রান মাসের বেলা। পশ্চিমে সূর্য্য অস্ত গেল। সন্ধ্যা হ’তেই ঘোর অন্ধকার। কাছে তেঁতুল গাছ। তার উপরে দুজনে চ’ড়ে বসলেন। গাছের গুঁড়ির সঙ্গে চাদর দিয়ে নিজেদের বাঁধলেন। পাছে ঘুম এলে প’ড়ে যান। কোথাও আলো নেই। তারা দেখা যায় না। কেবল অসংখ্য জোনাকি গাছে গাছে জ্বলছে।

শক্তিবাবুর একটু নিদ্রা এসেছে এমন সময় হঠাৎ ধুপ্‌ ক’রে একটা শব্দ হওয়াতে চমকে জেগে উঠলেন। দেখলেন কখন বাঁধন আল্‌গা হয়ে আক্রম নীচে প’ড়ে গেছে। শক্তিনাথ তাকে দেখতে তাড়াতাড়ি নেমে এলেন। হঠাৎ দেখেন, কাছেই অন্ধকারে দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে। কী সর্বনাশ! এ তো বাঘের চোখ। বন্দুক তোলবার সময় নেই। ভাগ্যে দুজনের কাছে দুটো বিজ‍্‌লি বাতির মশাল ছিল। সে-দুটো যেমনি হঠাৎ জ্বালানো অমনি বাঘ ভয়ে দৌড় দিলে। সে-রাত্রি আবার দুজনের গাছে কাটল। পরের দিন সকাল হ’লো। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা মেলে না, যতই চলেন জঙ্গল বেড়ে যায়। গায়ে কাঁটার আঁচড় লাগে। রক্ত পড়ে। খিদে পেয়েছে। তেষ্টা পেয়েছে। এমন সময় মানুষের গলার শব্দ শোনা গেল। এক দল কাঠুরিয়া কাঠ কাটতে চলেছে। শক্তিবাবু বললেন— তোমাদের ঘরে নিয়ে চলো। রাস্তা ভুলেছি। কিছু খেতে দাও। নদীর ধারে একটা ঢিবির ’পরে তাদের কুঁড়ে ঘর। গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া। কাছে একটা মস্ত বটগাছ। তার ডাল থেকে লম্বা লম্বা ঝুরি নেমেছে। সেই গাছে যত রাজ্যের পাখীর বাসা।

কাঠুরিয়ারা শক্তিবাবুকে আক্রমকে যত্ন ক’রে খেতে দিলে। তালপাতার ঠোঙায় এনে দিলে চিঁড়ে আর বনের মধু। আর দিলে ছাগলের দুধ। নদী থেকে ভাঁড়ে ক’রে এনে দিলে জল। রাত্রে ভালো ঘুম হয় নি। শরীর ছিল ক্লান্ত। শক্তিবাবু বটের ছায়ায় শুয়ে ঘুমোলেন। বেলা যখন চার প্রহর তখন কাঠুরিয়ার সর্দার পথ দেখিয়ে নৌকোয় তাঁদের পৌঁছিয়ে দিলে। শক্তিবাবু দশ টাকার নোট বের ক’রে বললেন, বড়ো উপকার করেছো, বক‍্‌শিশ লও। সর্দার হাতজোড় ক’রে বললে, মাপ করবেন, টাকা নিতে পারবো না— নিলে অধর্ম হবে। এই ব’লে নমস্কার ক’রে সর্দার চ’লে গেল।