আত্মা
আত্মগঠন

সকল দ্রব্যই যাহা-কিছু নিজের অনুকূল উপযোগী তাহাই আপন শক্তি-প্রভাবে চারি দিক হইতে আকর্ষণ করিতে থাকে, বাকী আর সকলের প্রতি তাহার তেমন ক্ষমতা নাই। নিজেকে যথাযোগ্য আকারে ব্যক্ত ও পরিপুষ্ট করিবার পক্ষে যে-সকল পদার্থ সর্বাপেক্ষা উপযোগী উদ্ভিজ্জশক্তি কেবল তাহাই জল বায়ু মৃত্তিকা হইতে গ্রহণ করিতে পারে, আর কিছুই না। মানুষের জীবনীশক্তিও কিছুতেই আপনাকে উদ্ভিদ্‌শরীরের মধ্যে ব্যক্ত করিতে পারে না। সে নিজের চারি দিকে এমন সকল পদার্থই সঞ্চয় করিতে পারে যাহা তাহার নিজের প্রকাশের পক্ষে সর্বাপেক্ষা অনুকূল। মনের মধ্যে একটা পাপের সংকল্প তাহার চারি দিকে সহস্র পাপের সংকল্প আকর্ষণ করিয়া আপনাকে আকারবদ্ধ করিয়া তুলে ও প্রতিদিন বৃহৎ হইতে থাকে। পুণ্যসংকল্পও সেইরূপ। সজীবতার ইহাই লক্ষণ। আমরা যখন একটি প্রবন্ধ লিখি, তখন কিছু সেই প্রবন্ধের প্রত্যেক ভাব প্রত্যেক কথা ভাবিয়া লিখিতে বসি না। একটা মুখ্য সজীব ভাব যদি আমার মনে আবির্ভূত হয়, তবে সে নিজের শক্তি-প্রভাবে আপনার অনুকূল ভাব ও শব্দগুলি নিজের চারি দিকে গঠিত করিতে থাকে। আমি যেসেকল ভাব কোন-কালেও ভাবি নাই তাহাদিগকেও কোথা হইতে আকর্ষণ করিয়া আনে। এইরূপে সে একটি পরিপূর্ণ প্রবন্ধ-আকার ধারণ করিয়া আপনাকে আপনি মানুষ করিয়া তুলে। এই জন্য, প্রবন্ধের মর্মস্থিত মুখ্য ভাবটি যত সজীব হয় প্রবন্ধ ততই ভাল হয়; নির্জীব ভাব আপনাকে আপনি গড়িতে পারে না, বাহির হইতে তাহার কাঠামো গড়িয়া দিতে হয়। এই নিমিত্ত ভাল লেখা লেখকের পক্ষেও একটি শিক্ষা। তিনি যতই অগ্রসর হইতে থাকেন ততই নূতন জ্ঞান লাভ করিতে থাকেন।


আত্মার সীমা

আমার মনে হয়, মানুষের আত্মাও এইরূপ ভাবের মত। ভাব নিজেকে ব্যক্ত করিতে চায়। যেটি তাহার নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহ্য বিকাশ তাহাই আশ্রয় করিতে করিতেই তাহার ক্রমাগত পুষ্টিসাধন হয়। আমরা মনের মধ্যে যাহা অনুভব করি কার্যই তাহার বাহ্য প্রকাশ। এই জন্য আমাদের অধিকাংশ অনুভব কাজ করিবার জন্য ব্যাকুল, আবার কাজ যতই সে করিতে থাকে ততই সে বাড়িয়া উঠিতে থাকে। আমাদের আত্মাও সেইরূপ সর্বাপেক্ষা অনুকূল অবস্থায় নিজেকে প্রকাশ করিতে চায়। এবং সেই প্রকাশচেষ্টা-রূপ কার্যেতেই তাহার উত্তরোত্তর পুষ্টিসাধন হইতে থাকে। চারি দিকের বাতাস হইতে সে আপনার অনুরূপ ভাবনা কামনা প্রবৃত্তি আকর্ষণ করিয়া নিজের আবরণ, নিজের সীমা নিজে রচনা করিতে থাকে। অবশিষ্ট আর কিছুরই উপরে তাহার কোন প্রভুত্ব নাই। আমরা সকলেই বন্ধু বান্ধব ও অবস্থার দ্বারা বেষ্টিত হইয়া একটি যেন ডিম্বের মধ্যে বাস করিতেছি, ঐটুকুর মধ্য হইতেই আমাদের উপযোগী খাদ্য শোষণ করিতেছি। একটি ব্যক্তিবিশেষকে যখন আমরা দেখি তখন তাহার চারি দিকের মণ্ডলী আমরা দেখিতে পাই না। কিন্তু তাহার সেই খাদ্যাধার-মণ্ডলী তাহার সঙ্গে সঙ্গে অলক্ষিত ভাবে ফিরিতেছে। যে ব্যক্তি সৌন্দর্যপ্রিয় সে তাহার দেহের মধ্যে, তার চর্মাবরণটুকুর মধ্যে, বাস করে না। সে তাহার চারি দিকের তরুলতার মধ্যে আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে বাস করে। সে যেখানেই যায় চন্দ্রসূর্যময় আকাশ তাহার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে, তৃণ-পত্র-পুষ্প-ময়ী বনশ্রী তাহাকে ঘিরিয়া রাখে। ইহারা তাহার ইন্দ্রিয়ের মত। চন্দ্রসূর্যের মধ্য দিয়া সে কি দেখিতে পায়; কুসুমের সৌগন্ধ্য ও সৌন্দর্যের সাহায্যে তাহার হৃদয়ের ক্ষুধা নিবৃত্ত হইতে থাকে।