আত্মা
আমরা পরের সুখের জন্য নিজেকে দুঃখ দিতে কাতর হই না। কোথাও ইহার “ কেন” খুঁজিয়া পাই না। কেবল হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিতে পারি যে, নিজের-ক্ষুধায়-কাতর সংগ্রামপরায়ণ এই জগৎ অতিক্রম করিয়া আর এক জগৎ আছে, ইহা সেইখানকার নিয়ম। সুতরাং এইখানেই পরিণাম দেখিতেছি না। চারি দিকে এই-যে বস্তুজগতের ঘোর কারাগারভিত্তি উঠিয়াছে, ইহাই আমাদের অনন্ত কবর-ভূমি নহে। অতএব যখনি আমরা আত্মবিসর্জন করিতে শিখিলাম তখনি আমাদের গুরুভার ঐহিক দেহের উপরে দুটি পাখা উঠিল। পৃথিবীর মাটিতে চলিবার সময় সে পাখা দুটির কোন অর্থ বুঝা গেল না। কিন্তু ইহা বুঝা গেল যে ঐ পাখা দুটি কেবলমাত্র তাহার শোভা নহে, উহার কার্য আছে। তবে যাহাদের এই পাখা জন্মায় নাই তাহাদেরও কি আকাশে উঠিবার অধিকার আছে?


স্থায়িত্ব

আমাদের মধ্যে যে-সকল উচ্চ আশা যে-সকল মহত্ত্ব বিরাজ করিতেছে তাহারাই স্থায়ী; আর যাহারা তাহাদিগকে বাধা দিয়াছে, তাহাদিগকে কার্যে পরিণত হইতে দেয় নাই, তাহারা নশ্বর। তাহারা এইখানকারই জিনিষ, তাহারা কিছু সঙ্গে সঙ্গে যাইবে না। আমার মধ্যে যে-সকল নিত্য পদার্থ বিরাজ করিতেছে তাহা তোমরা দেখিতে পাইতেছ না; তাহাদের চারিদিকে যে জড়স্তূপ উত্থিত হইয়া কিছু দিনের মত তাহাদিগকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে, তাহাই তোমরা দেখিতেছ। আমার মনের মধ্যে যে ধর্মের আদর্শ বর্তমান রহিয়াছে তাহারই উপর আমার স্থায়িত্ব নির্ভর করিতেছে। যখন কাষ্ঠলোষ্ট্রের মত সমস্ত পড়িয়া থাকে তখন ধর্মই আমাদের অনুগমন করে। যাহার আত্মায় এ আদর্শ নাই, দেহের সহিত তাহার সম্পূর্ণ মৃত্যু হয়। জড়ত্বই তাহার পরিণাম। যে গেছে, সে তাহার জীবনের সার পদার্থ লইয়া গেছে, তাহার যা যথার্থ জীবন তাহাই লইয়া গেছে, আর তাহার দুদিনের সুখ দুঃখ, দুদিনের কাজকর্ম আমাদের কাছে রাখিয়া গেছে। তাহার জীবনে অনেক সময়ে আজিকার মতের সহিত কালিকার মতের অনৈক্য দেখিয়াছি; এমন-কি তাহার মত একরূপ শুনা গিয়াছে, তাহার কাজ আর একরূপ দেখা গিয়াছে—এই-সকল বিরোধ অনৈক্য চঞ্চলতা তাহার আত্মার জড় আবরণের মত এইখানেই পড়িয়া রহিল, ইহাকে অতিক্রম করিয়া যে ঐক্য যে অমরতা অধিষ্ঠিত ছিল তাহাই কেবল চলিয়া গেল। যখন তাহার দেহ দগ্ধ করিয়া ফেলিলাম তখন এগুলিও দগ্ধ করিয়া শ্মশানে ফেলিয়া আসা যাক্‌। তাহার সেই মৃত অনিত্যগুলিকে লইয়া অনর্থক সমালোচনা করিয়া কেন তাহার প্রতি অসম্মান করি? তাহার মধ্যে যে সত্য, যে দেবতা ছিল, যে থাকিবে, সেই আমাদের হৃদয়ের মধ্যে অধিষ্ঠান করুক!