কথাবার্তা
সন্ধ্যাবেলায়
১ম। আমি সন্ধ্যা কেন এত ভালবাসি জিজ্ঞাসা করিতেছ?

সমস্ত দিন আমরা পৃথিবীর মধ্যেই থাকি—সন্ধ্যাবেলায় আমরা জগতে বাস করি। সন্ধ্যাবেলায় দেখিতে পাই, পৃথিবী অপেক্ষা পৃথিবী-ছাড়াই বেশী—এমন লক্ষ লক্ষ পৃথিবী কুচি কুচি সোনার মতো আকাশের তলায় ছড়াছড়ি যাইতেছে। জগৎ-মহারণ্যের একটি বৃক্ষের একটি শাখার একটি প্রান্তে একটি অতি ক্ষুদ্র ফল প্রতিদিন পাকিতেছে। তাহাই পৃথিবী। দিনে দেখিতাম পৃথিবীর মধ্যে ছোটোখাটো যাহা-কিছু সমস্তই চলাফিরা করিতেছে, সন্ধ্যাবেলায় দেখিতে পাই পৃথিবী স্বয়ং চলিতেছে। রেলগাড়ি যেমন পর্বতের খোদিত গুহার মধ্যে প্রবেশ করে—তেমনি, পৃথিবী তাহার কোটি কোটি আরোহী লইয়া একটি সুদীর্ঘ অন্ধকারের গুহার মধ্যে যেন প্রবেশ করিতেছে—এবং সেই ঘোরা নিশীথগুহার ছাদের মণ্ডপে অযুত গ্রহ তারা একেকটি প্রদীপ ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে—তাহারি নীচে দিয়া একটি অতি প্রকাণ্ডকায় গোলক নিঃশব্দে অবিশ্রাম গড়াইয়া চলিতেছে।

২য়। এই বৃহৎ পৃথিবী সত্য সত্যই যে অসীম আকাশে পথচিহ্নহীন পথে অহর্নিশি হুহু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে, এক নিমেষও দাঁড়াইতে পারিতেছে না, ইহা একবার মনের মধ্যে অনুভব করিলে কল্পনা স্তম্ভিত হইয়া থাকে।

১ম। এমন একটি পৃথিবী কেন—যখন মনে করিতে চেষ্টা করা যায় যে ঠিক এই মুহূর্তেই অনন্ত জগৎ প্রচণ্ড বেগে চলিতেছে এবং তাহার প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম পরমাণু থর্‌ থর্‌ করিয়া কাঁপিতেছে, অতি বৃহৎ অতি গুরুভার লক্ষকোটি অযুত নিযুত চন্দ্র সূর্য তারা গ্রহ উপগ্রহ উল্কা ধূমকেতু লক্ষযোজনব্যাপ্ত নক্ষত্রবাষ্পরাশি কিছুই স্থির নাই, অতি বলিষ্ঠ বিরাট এক যাদুকর পুরুষ যেন এই অসংখ্য অনলগোলক লইয়া অনন্ত আকাশে অবহেলে লোফালুফি করিতেছে (কি তাহার প্রকাণ্ড বলিষ্ঠ বাহু! কি তাহার বজ্রকঠিন বিপুল মাংসপেশী! ), প্রতি পলকেই কি অসীম শক্তি ব্যয় হইতেছে—তখন কল্পনা অনন্তের কোন্‌ প্রান্তে বিন্দু হইয়া হারাইয়া যায়!

২য়। অথচ দেখো, মনে হইতেছে প্রকৃতি কি শান্ত!

১ম। প্রকৃতি আমাদের সকলকে জানাইতে চায় যে, তোমরাই খুব মস্ত লোক—তোমরা আমাকে ছাড়াইয়া গিয়াছ। বিদ্যুৎমায়াবিনীকে তার দিয়া বাঁধিয়াছ—বাষ্পদানবকে লৌহকারাগারে বাঁধিয়া তাহার দ্বারা কাজ উদ্ধার করিতেছ। প্রকৃতি যে অতি বৃহৎ কার্যগুলি করিতেছে তাহা আমাদের কাছ হইতে কেমন গোপন করিয়া রাখিয়াছে, আর আমরা যে অতি ক্ষুদ্র কাজটুকুও করি তাহাই আমাদের চোখে কেমন দেদীপ্যমান করিয়া দেয়।

২য়। নহিলে, আমরা যদি প্রত্যক্ষ দেখিতে পাই অনন্তের কাজ চলিতেছে, তাহা হইলে কি আমরা আর কাজ করিতে পারি!

১ম। কম কাজ! বড়ো হইতে ছোট পর্যন্ত দেখো। অতি মহৎ শক্তি-সম্পন্ন কত সহস্র নক্ষত্রলোক, অথচ দেখো; তাহারা ছোটো ছোটো মাণিকের মতো কেবল চিক্‌চিক্‌ করিতেছে মাত্র! আমরা ফুলবাগানের মধ্যে বসিয়া আছি, মনে হইতেছে চারি দিকে যেন ছুটি। অথচ প্রতি গাছে পাতায় ফুলে ঘাসে অবিশ্রাম কাজ চলিতেছে—রাসায়নিক যোগ-বিয়োগের হাট বসিয়া গিয়াছে, কিন্তু দেখো, উহাদের মুখে গলদ্‌ঘর্ম্ম পরিশ্রমের ভাব কিছুমাত্র নাই। কেবল সৌন্দর্য, কেবল বিরাম, কেবল শান্তি! আমি যখন আরাম করিতেছি তখনো আমার আপাদমস্তকে কাজ চলিতেছে—আমার শরীরের প্রত্যেক কাজ যদি মেহন্নত করিয়া আমার নিজেকেই করিতে হইত তাহা হইলে কি আর জীবন ধারণ করিয়া সুখ থাকিত!