কথাবার্তা

২য়। প্রকৃতি বলিতেছে, আমি তোমার জন্য বিস্তর কাজ করিয়া দিতেছি, আর তুমি কি তোমার নিজের জন্য কিছু করিবে না! জড়ের সহিত তোমার প্রভেদ এই যে, তোমার নিজের জন্য অনেক কাজ তোমার নিজেকেই করিতে হয়। তুমি পুরুষের মত আহার উপার্জন করিয়া আন, তার পরে সেটাকে পাকযন্ত্রে রাঁধিয়া লইবার অতি কৌশলসাধ্য কার্য্যভার সে আমার উপরে রহিল—তাহার জন্যে তুমি বেশী ভাবিও না। তুমি কেবল চলিবার উদ্যম কর, দেখিবে আমি তোমাকে চালাইয়া লইয়া যাইব।

১ম। ঠিক কথা, কিন্তু প্রকৃতি কখনো বলে না যে, আমি করিতেছি। আমাদের বেশীর ভাগ কাজ যে প্রকৃতি সম্পন্ন করিয়া দিতেছে তাহা কি আমরা জানি? আমাদের নিরুদ্যমে যে শতসহস্র কাজ চলিতেছে, তাহা চলিতেছে বলিয়া আমাদের চেতনাই থাকে না। এই-যে অতি কোমল বাতাস বহিতেছে, এই-যে আমার চোখের সমুখে গঙ্গার ছোট ছোট তরঙ্গগুলি মৃদু মৃদু শব্দ করিতে করিতে তটের উপরে মুহুর্মুহু লুটাইয়া পড়িতেছে, ইহারা আমার হৃদয়ের এই অতি তীব্র শোক অহরহ শান্ত করিতেছে। জগতের চতুর্দ্দিক হইতে আমার উপর অবিশ্রাম সান্ত্বনা বর্ষিত হইতেছে, অথচ আমি জানিতে পারিতেছি না, অথচ কেহই একটি সান্ত্বনার বাক্য বলিতেছে না—কেবল অলক্ষ্যে অদৃশ্যে আমার হৃদয়ের উপরে তাহাদের মন্ত্রপূত হাত বুলাইয়া যাইতেছে, আহাউহুটুকুও বলিতেছে না। আমাদের চতুর্দ্দিক্‌বর্ত্তী এই যে কার্য্যকুশল সদাব্যস্ত ব্যক্তিগণ গুপ্তভাবে থাকে সে কেবল আমাদিগকে ভুলাইবার জন্য, আমাদিগকে জানাইবার জন্য যে আমরাই স্বাধীন।

২য়। অর্থাৎ, অধীনতা খুব প্রকাণ্ড হইলে তাহাকে কতকটা স্বাধীনতা বলা যাইতে পারে –কারাগার যদি মস্ত হয়, তবে তাহাকে কারাগার না বলিলেও চলে। বোধ করি, আমাদিগকে স্থায়ীরূপে অধীন রাখিবার জন্য এই উপায় অবলম্বন করা হইয়াছে। পাছে মুহুর্মুহু আমাদের চেতনা হয় যে আমরা অধীন, ও বৈরাগ্য-সাধনা-দ্বারা প্রকৃতির শাসন লঙ্ঘন করিয়া স্বাধীন হইতে চেষ্টা করি, এই ভয়ে প্রকৃতি আমাদের হাত হইতে হাতকড়ি খুলিয়া লইয়া আমাদিগকে একটা বেড়া-দেওয়া জায়গায় রাখিয়া দিয়াছে। আমরা ভুলিয়া থাকি আমরা অধীনতার দ্বারা বেষ্টিত, মনে করি আমরা ছাড়া পাইয়াছি।

১ম। কিম্বা এমনও হইতে পারে প্রকৃতি আমাদিগকে স্বাধীনতার শিক্ষা দিতেছেন। দেখ-না কেন, উত্তরোত্তর কেমন স্বাধীনতারই বিকাশ হইতেছে। জড় যে, সে নিজের জন্য কিছুই করিতে পারে না। উদ্ভিদ তাহার চেয়ে কতকটা উচ্চ। কারণ টিঁকিয়া থাকিবার জন্য খানিকটা যেন তাহার নিজের উদ্যমের আবশ্যক, তাহাকে রস আকর্ষণ করিতে হয়, বাতাস হইতে আহার্য্য সংগ্রহ করিতে হয়। মানুষ এত বেশী স্বাধীন যে, প্রকৃতি বিস্তর প্রধান প্রধান কাজ বিশ্বাস করিয়া আমাদের নিজের হাতেই রাখিয়া দিয়াছেন। আর, স্বাধীনতা জিনিষ বড় সামান্য নহে। জড়ের কোন বালাই নাই। আমরা, মানুষেরা, কি করিলে যে ভাল হইবে পদে পদে তাহা ভাবিয়া পাই না। আকুল হইয়া একবার এটা দেখিতেছি, একবার ওটা দেখিতেছি; এবং এইরূপ পরীক্ষা করিতে করিতেই আমরা শত সহস্র করিয়া মারা পড়িতেছি। উত্তরোত্তর যেরূপ স্বাধীনতার বিকাশ হইয়া আসিয়াছে ইহারই যদি ক্রমিক চালনা হয়, তাহা হইলে মানুষের পর এমন জীব জন্মাইবে যাহার ক্ষুধা পাইবে না অথচ বিবেচনাপূর্বক আহার করিতে হইবে (অনেক মানুষেরই তাহা করিতে হয়), রক্তসঞ্চালন ও পরিপাককার্য্য তাহার নিজের কৌশলে করিয়া লইতে হইবে (মানুষের রন্ধন-কার্য্যও কতকটা তাহাই), ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার শরীরের পরিণতি সাধন করিতে হইবে—এক কথায়, তাহার আপাদমস্তকের সমস্ত ভার তাহার নিজের হাতে পড়িবে। তাহার প্রত্যেক কার্য্যের ফলাফল সে অনেকটা পর্য্যন্ত দেখিতে পাইবে। একটি কথা কহিলে আঘাতজনিত বাতাসের তরঙ্গ কত দূরে কত বিভিন্ন শক্তিরূপে রূপান্তরিত হইবে তাহা সে জানিবে, এবং তাহার সেই কথার ভাব সমাজের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কত হৃদয়কে কতরূপে বিচলিত করিবে, তাহার ফল পুরুষানুক্রমে কত দূরে কি আকারে প্রবাহিত হইবে তাহা বুঝিতে পারিবে।