তপতী

সুমিত্রা। ফল কী হল।

দেবদত্ত। শুনে লাভ নেই। রাজারা যখন অন্যায় করেন তখন তার সমর্থনের জন্যে অতি ভীষণ হয়ে ওঠেন।

সুমিত্রা। ঠাকুর, ভীষণতা অন্যায়ের ছদ্মবেশ; ভয় ক’রে তাকে যেন সম্মান না করি। অন্যায়কারীকে ক্ষুদ্র বলেই জানতে হবে, অতি ক্ষুদ্র, তার হাতে যত বড়ো একটা দণ্ড থাক্‌। তাকে যদি ভয় করি তবে তার চেয়েও ক্ষুদ্র হতে হবে। শিলাদিত্য উৎসবের নিমন্ত্রণে রাজধানীতে এসেছে?

দেবদত্ত। হাঁ, এসেছে।

সুমিত্রা। মন্ত্রীকে আদেশ করো তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।

দেবদত্ত। মহারানী!

সুমিত্রা। তুমি যা বলবে আমি তা সব জানি, সমস্ত জেনেই বলছি আজ তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হওয়া চাই।

দেবদত্ত। আগে উৎসব সমাধা হোক।

সুমিত্রা। এ পাপের বিচার না হলে আজ উৎসব হতেই পারবে না।

দেবদত্ত। মহারানী, সাবধান হবার অত্যন্ত প্রয়োজন আছে।

সুমিত্রা। আমাকে নিবৃত্ত কোরো না। একদিন আগুনে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলুম, সুবিজ্ঞের পরামর্শে নিবৃত্ত হয়েছি। তখনই সংকল্প রক্ষা করলে এত অমঙ্গল ঘটত না এ জগতে। শিলাদিত্যের বিচার যদি না হয় তাহলে এ রাজত্বে রানী হবার লজ্জা আমি সইব না। ঐ-যে গর্জন শুনতে পাচ্ছি দ্বারের বাইরে।

দেবদত্ত। দয়াময়ী, কতটুকুই বা শুনলে। সবটা কানে উঠলে কান বধির হয়ে যেত। যে নিঃসহায়দের সামনে সকল দ্বার রুদ্ধ তাদের কণ্ঠও রুদ্ধ থাকে, তাই তো আছি আমরা আরামে। বাধা আজ অল্প-একটু বুঝি সরেছে — তাই গুমরে ওঠা দুঃখসমুদ্রের ধ্বনি সামান্য একটু শোনা গেল।

সুমিত্রা। ঠাকুর, বাধা আছে তো আছে— কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছে কেন, ভীরু সব। বিধাতা যাদের অবজ্ঞা করেন তাদের দয়া করেন না তাও কি এরা জানে না? দ্বার ভেঙে ফেলুক-না। বিচার ভয়ে ভয়ে চায় বলেই তো ওরা বিচার পায় না। রাজা যত বড়ো জোরের সঙ্গে ওদের কাছে কর দাবি করে, তত বড়ো জোরের সঙ্গেই ওদের বিচার চাবার অধিকার। ধর্মের বিধান মানুষের অনুগ্রহের দান নয়। আমাকে নিয়ে চলো ঠাকুর, ওদের মাঝখানে।

দেবদত্ত। মহারানী, তোমার নিজের জায়গায় থাকলেই ওদের বাঁচাতে পারবে; তোমার আসন যেখানে তোমার শক্তি সেখানেই।

সুমিত্রা। আমার আসন! আমার আসন আমি পাই নি। অহর্নিশি সেই শূন্যতা সইতে পারছি নে, মন কেবলই বলছে, রুদ্রভৈরবের পায়ের কাছেই আমার স্থান— দেখিয়ে দিন তিনি পথ, ভেঙে দিন তিনি বিঘ্ন, ব্যর্থতার অপমান থেকে সেবিকাকে উদ্ধার করুন।

[ উভয়ের প্রস্থান
নরেশ ও বিপাশার প্রবেশ

নরেশ। শোনো শোনো, বিপাশা, শুনে যাও।

বিপাশা। শোনবার যোগ্য কথা থাকলে তবেই শুনব।