প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
মনে করো, আমাদের মাস্টারমশায়। তিনি অদ্ভুত ছিলেন, কিন্তু খাঁটি অদ্ভুত। তাই তাঁকে এত ভালো লাগত।
আচ্ছা, তাঁর কথাটা একটু ধরিয়ে দাও - না।
আজও তাঁর মুখখানা স্পষ্ট মনে পড়ে। ক্লাসে বসতেন যেন আলগোছে, বইগুলো ছিল কণ্ঠস্থ। উপরের দিকে তাকিয়ে পাঠ বলে যেতেন, কথাগুলো যেন সদ্য ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। আমরা ক্লাসে উপস্থিত থাকব, মন দিয়ে পড়া শুনব, সে গরজটা সম্পূর্ণ আমাদেরই বলে তিনি মনে করতেন।
তিনি তোমাদের মুখ চেনবার সুযোগ পান নি বোধ হয়।
চেষ্টাও করেন নি। একদিন ছুটির দরবার নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকতেই তিনি শশব্যস্ত হয়ে চৌকি ছেড়ে উঠে পড়লেন ; মনে করলেন, আমি বুঝি যাকে বলে একজন রীতিমত মহিলা।
অমনতরো অভাবনীয় ভুল করা তাঁর অভ্যস্ত ছিল।
ছিল বৈকি। তোমার দাড়ি দেখে কোনোদিন তোমাকে নবাব খাঞ্জেখাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি বলে ভুল করেন নি তো? না,
ঠাট্টা নয়, তিনি তো তোমার বন্ধু ছিলেন, বলো - না তাঁর কথা।
তাঁর শত্রু কেউ ছিল না, কিন্তু সমজদার বন্ধু ছিলুম একলা আমি। লোকে যখন তাঁর খ্যাপামির কথা রটাত তিনি আশ্চর্য হয়ে যেতেন। একদিন আমাকে এসে বললেন, সবাই বলছে, আমি ক্লাস পড়াই কিন্তু ক্লাসের দিকে তাকাই নে।
আমি বললুম, তোমার সাঙাৎরা তোমার বিদ্যের দোষ ধরতে পারে না, তোমার বুদ্ধির দোষ ধরে। তারা বলে, তোমার পড়ানোর ভুল হয় না কিন্তু পড়াচ্ছ যে সেইটেই ভুলে যাও।
পড়াচ্ছি যদি না ভুলি তবে পড়াতে পারতুম না, নিছক মাস্টারিই করে যেতুম। পড়ানোটা নিঃশেষে হজম হয়ে গেছে, ওটা নিয়ে মনটা আইঢাই করে না।
জলচর জলে সাঁতার দিলে টের পাওয়া যায় না, স্থলচর দিলে সেটা খুবই মালুম হয়। তুমি অধ্যাপন - সরোবরের গভীর জলের মাছ।
আমি যদি ছাত্রদের দিকে তাকাই তবে ক্লাসের দিকে মন দেব কী করে।
তোমার সেই ক্লাসটা আছে কোথায়।
কোত্থাও না, সেইজন্যেই তো বাধা পাই নে। ছাত্ররাই যদি আমার চোখ জুড়ে বসে তা হলে ক্লাসের আত্মাপুরুষটা আড়ালে পড়ে যে।
‘ পড়ো বাবা আত্মারাম' এই বুঝি তোমার বুলি?
পড়াচ্ছি কই। আমার আত্মারামকেই টহল দেওয়াচ্ছি।
তোমার প্রণালীটা কিরকম।
গঙ্গাধারার বহে যাবার প্রণালী যেরকম। ডাইনে বাঁয়ে কোথাও মরু, কোথাও ফসল, কোথাও শ্মশান, কোথাও শহর। এই নিয়ে গঙ্গামায়ীকে পদে পদে বিচার করতে যদি হত তা হলে আজ পর্যন্ত সগরসন্তানদের উদ্ধার হত না। যাদের যতটা হবার তাই হয়, বিধাতার সঙ্গে টক্কর দিয়ে তার চেয়ে বেশি হওয়াতে গেলেই চলা বন্ধ। আমার পড়ানো চলে মেঘের মতো শূন্য দিয়ে, বর্ষণ হয় নানা খেতে, ফসল ফলে খেত - অনুসারে। অসম্ভবকে নিয়ে ঠেলাঠেলি করে সময় নষ্ট করি নে বলে হেড্মাস্টার হন ক্ষাপা। ঐ হেড্মাস্টারটিকেও অত্যন্ত সত্য বলে গণ্য করলে অত্যন্ত ভুল করা হয়।