ছন্দের হসন্ত হলন্ত
অচে- | তনে- | ছিলেম | ভালো- |
আমায় | চেতন | করলি | কেনে- |

প্রাকৃত-বাংলার এই তিন মাত্রার ভঙ্গি চণ্ডীদাস জ্ঞানদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিরা সাধুভাষাতেও গ্রহণ করেছেন। যেমন–

হাসিয়া হাসিয়া মুখ নিরখিয়া
           মধুর কথাটি কয়।
ছায়ার সহিতে ছায়া মিশাইতে
           পথের নিকটে রয়।

কিন্তু প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ নিয়ে একটু ভাববার বিষয় আছে।

মত্তরোষে বীরভদ্র ছুট্‌ল ঊর্ধ্বশ্বাসে,
ঘূর্ণিবেগে উড়্‌ল ধুলো রক্ত সন্ধ্যাকাশে।

কিংবা–

ছুট্‌ল কেন মহেন্দ্রের আনন্দের ঘোর,
টুট্‌ল কেন উর্বশীর মঞ্জীরের ডোর।
বৈকালে বৈশাখী এল আকাশলুণ্ঠনে,
শুক্লরাতি ঢাক্‌ল মুখ মেঘাবগুণ্ঠনে।

এদের সম্বন্ধে কী বলা যাবে।

প্রধানত ক্রিয়াপদেরই বিশেষ রূপটাতে প্রাকৃত-বাংলার চেহারা ধরা পড়ে। উপরের ছড়াগুলিতে ‘উড়্‌ল’ ‘ছুট্‌ল’ ‘টুট্‌ল’ ‘ঢাক্‌ল’ প্রভৃতি প্রয়োগ নিয়ে তর্কটা ছন্দের তর্ক নয়, ভাষারীতির। এইরকম ক্রিয়াপদ যদি ব্যবহার করি তবে ধরে নিতে হবে ঐ ছড়াগুলি প্রাকৃত-বাংলাতেই লেখা হচ্ছে। আমি যে প্রবন্ধ লিখছি এও প্রাকৃত-বাংলার ঠাটে। যদি আমাকে কারো সঙ্গে মুখে মুখে আলোচনা করতে হত তাহলে এই লেখার সঙ্গে আমার মুখের কথার কোনো তফাত থাকত না। মাঝে মাঝে অভ্যাসদোষে হয়তো ইংরেজি শব্দ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেত, কিন্তু কখনোই ‘করিয়াছিল’ ‘গিয়াছে’ ধরনের ক্রিয়াপদ ভুলেও ব্যবহার করতে পারতুম না। আবার প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ সংস্কৃত-বাংলায় ব্যবহার করাও চলে না। প্রবোধচন্দ্র ‘বিচিত্রা’য় লিখেছেন যে, বাঙালি কবিরা সাহস করে কবিতায় ‘করিব’ ‘চলিব’ প্রভৃতি প্রয়োগ না করে কেন ‘করব’ ‘চলব’ প্রয়োগ না করেন। যদি প্রশ্নটার অর্থ এই হয় যে, অযথাস্থানে কেন করি নে তবে তার উত্তর দেওয়া অনাবশ্যক। যদি বলেন, যথাস্থানেও কেন করি নে, তবে তার উত্তরে বলব, যথাস্থানে করে থাকি।

যে তর্ক নিয়ে লেখা শুরু করেছিলেম সেটাতে ফিরে আসা যাক। বাংলায় হসন্তমধ্য শব্দগুলোয় কয় মাত্রা গণনা করা হবে, তাই নিয়ে সংশয় উঠেছে।

যেগুলি ক্রিয়াপদ নয় সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এ প্রবন্ধের গোড়াতেই আলোচনা করেছি। বলেছি, নিয়মের বিকল্প চলে; কেননা, বাঙালির কান সাধারণ ব্যবহারে সেই বিকল্প মঞ্জুর করেছে। এ ক্ষেত্রে হিসাবে একটা মাত্রার কমিবেশি নিয়ে তর্ক ওঠে না।

চিম্‌নি ভেঙে গেছে দেখে গিন্নি রেগে খুন;
ঝি বলে, আমার দোষ নেই ঠাকরুন।

অন্তত ‘চিমনি’কে দুই মাত্রা করায় কবির দোষ হয় নি। আবার