নৌকাডুবি

কমলা কহিল, “আজ যে কাজ আছে মা! কাল সন্ধ্যাবেলায় যে তরকারি আনানো হইয়াছে তাহাই কুটিয়া রাখি; আর যা-কিছু বাজার করা বাকি আছে, উমেশ সকাল-সকাল সারিয়া আসুক।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “বেশ বুদ্ধি ঠাওরাইয়াছ মা। বেয়াই যেমনি আসিবেন অমনি খাবার প্রস্তুত পাইবেন।

এমন সময় নলিনাক্ষ বাহির হইয়া আসিবামাত্র কমলা ভিজা চুলের উপর তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল। নলিনাক্ষ কহিল, “মা, আজই তুমি স্নান করিতে চলিলে? সবে কাল একটু ভালো ছিলে।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “নলিন, তোর ডাক্তারি রাখ্‌। সকালবেলায় গঙ্গাস্নান না করিলেও লোকে অমর হয় না। তুই এখন বাহির হইতেছিস বুঝি? একটু সকাল-সকাল ফিরিস।”

নলিনাক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “ কেন মা?”

ক্ষেমংকরী। কাল তোকে বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম, আজ অন্নদাবাবু তোকে আশীর্বাদ করিতে আসিবেন।

নলিনাক্ষ। আশীর্বাদ করিতে আসিবেন? কেন, হঠাৎ আমার উপরে এত বিশেষভাবে প্রসন্ন হইলেন যে? তাঁর সঙ্গে তো রোজই আমার দেখা হয়।

ক্ষেমংকরী। আমি যে কাল হেমনলিনীকে একজোড়া বালা দিয়া আশীর্বাদ করিয়া আসিলাম, এখন অন্নদাবাবু তোকে না করিলে চলিবে কেন? যা হোক, ফিরিতে দেরি করিস নে, তাঁরা এখানেই খাইবেন।

এই বলিয়া ক্ষেমংকরী স্নান করিতে গেলেন। নলিনাক্ষ মাথা নিচু করিয়া ভাবিতে ভাবিতে রাস্তা দিয়া চলিয়া গেল।


৫৮

হেমনলিনী রমেশের নিকট হইতে দ্রুতবেগে পলায়ন করিয়া ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বিছানার উপর বসিয়া পড়িল। প্রথম আবেগটা শান্ত হইবামাত্র একটা লজ্জা তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া দিল। ‘কেন আমি রমেশবাবুর সঙ্গে সহজভাবে দেখা করিতে পারিলাম না? যাহা আশা করি না, তাহাই হঠাৎ কেন আমার মধ্য হইতে এমন অশোভন ভাবে দেখা দেয়? বিশ্বাস নাই, কিছুই বিশ্বাস নাই। এমন করিয়া টল্‌মল্‌ করিতে আর পারি না।’

এই বলিয়া সে জোর করিয়া উঠিয়া পড়িয়া দরজা খুলিয়া দিল, বাহির হইয়া আসিল; মনে মনে কহিল, ‘আমি পলায়ন করিব না, আমি জয় করিব।’ পুনর্বার রমেশবাবুর সঙ্গে দেখা করিতে চলিল। হঠাৎ কী মনে পড়িল। আবার সে ঘরের মধ্যে গেল। তোরঙ্গ খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে ক্ষেমংকরীর প্রদত্ত বালাজোড়া বাহির করিয়া পরিল, এবং অস্ত্র পরিয়া যুদ্ধে যাইবার মতো সে আপনাকে দৃঢ় করিয়া মাথা তুলিয়া বাগানের দিকে চলিল।

অন্নদাবাবু আসিয়া কহিলেন, “হেম, তুমি কোথায় চলিয়াছ?”

হেমনলিনী কহিল, “রমেশবাবু নাই? দাদা নাই?”

অন্নদা। না, তাঁহারা চলিয়া গেছেন।

আশু আত্মপরীক্ষাসম্ভাবনা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া হেমনলিনী আরাম বোধ করিল।

অন্নদাবাবু কহিলেন, “এখন তবে— ”

হেমনলিনী কহিল, “হাঁ বাবা, আমি চলিলাম; আমার স্নান করিয়া আসিতে দেরি হইবে না, তুমি গাড়ি ডাকিতে বলিয়া দাও।

এইরূপে হেমনলিনী নিমন্ত্রণে যাইবার জন্য হঠাৎ তাহার স্বভাববিরুদ্ধ অত্যন্ত উৎসাহ প্রকাশ করিল। এই উৎসাহের আতিশয্যে