প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
মনে আছে আমার পিতার কোনো ভৃত্যের কাছে ছেলেবেলায় আমরা গল্প শুনেছি যে, সে যখন পুরীতীর্থে গিয়েছিল তার মহা ভাবনা পড়েছিল জগন্নাথকে কী দেবে। তাঁকে যা দেবে সে তো কখনো সে আর ভোগ করতে পারবে না, সেইজন্যে সে যে জিনিসের কথাই মনে করে কোনোটাই তার দিতে মন সরে না–যাতে তার অল্পমাত্রও লোভ আছে সেটাও, চিরদিনের মতো দেবার কথায়, মন আকুল করে তুলতে লাগল। শেষকালে বিস্তর ভেবে সে জগন্নাথকে বিলিতি বেগুন দিয়ে এল। এই ফলটিতেই সে লোকের সবচেয়ে কম লোভ ছিল।
আমরাও ঈশ্বরের জন্যে কেবলমাত্র সেইটুকুই ছাড়তে চাই যেটুকুতে আমাদের সবচেয়ে কম লোভ–যেটুকু আমাদের নিতান্ত উদ্বৃত্তের উদ্বৃত্ত। ঈশ্বরের নাম-গাঁথা দুটো-একটা মন্ত্র পাঠ করা গেল, দুটি-একটি সংগীত শোনা গেল,যাঁরা বেশ ভালো বক্তৃতা করতে পারেন তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত বক্তৃতা শোনা গেল। বললুম বেশ হল, বেশ লাগল, মনটা এখন বেশ পবিত্র ঠেকছে–আমি ঈশ্বরের উপাসনা করলুম।
একেই আমরা বলি উপাসনা। যখন বিদ্যার ধনের বা মানুষের উপাসনা করি তখন সেটা এত সহজ উপাসনা হয় না, তখন উপাসনা যে কাকে বলে তা বুঝতে বাকি থাকে না। কেবল ঈশ্বরের উপাসনাটাই হচ্ছে উপাসনার মধ্যে সবচেয়ে ফাঁকি।
এর মানে আর কিছুই নয়, নিজের অংশটাকে সবচেয়ে বড়ো করে ঘের দিয়ে নিয়ে ঈশ্বরকে একপাই অংশের শরিক করি এবং মনে করি আমার সকল দিক রক্ষা হল।
আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে “যা দ্বয়লোকসাধনী তনুভৃতাং সা চাতুরী চাতুরী”– যাতে দুই লোকেরই সাধনা হয় মানুষের সেই চাতুরীই চাতুরী।
কিন্তু যে-চাতুরী দুইলোক রক্ষার ভার নেয় শেষকালে সে ওই দুই লোকের মধ্যে একটা লোকের কথা ভুলতে থাকে, তার চাতুরী ঘুচে যায়। যে-লোকটি আমার দিকের লোক অধিকাংশ স্থলে সেই দিকের সীমানাই অজ্ঞাতসারে এবং জ্ঞাতসারে বেড়ে চলতে থাকে। ঈশ্বরের জন্যে ওই যে একপাই জমি রেখেছিলুম, যদি তাতে কোনো পদার্থ থাকে, যদি সেটা নিতান্তই বালিচাপা মরুভূমি না হয়, তবে একটু একটু করে লাঙল ঠেলে ঠেলে সেটা আত্মসাৎ করে নেবার চেষ্টা করি। “আমি” জিনিসটা যে একটা মস্ত পাথর, তার ভার যে ভয়ানক ভার। যে-দিকটাতে সেই আমিটাকে চাপাই সেই দিকটাতেই যে ধীরে ধীরে সমস্তটাই কাত হয়ে পড়তে চায়। যদি রক্ষা পেতে চাও, তবে ওইটেকেই একেবারে জলের মধ্যে ফেলে দিতে পারলেই ভালো হয়।
আসল কথা, সবটাই যদি ঈশ্বরকে দিতে পারি তা হলেই দুই লোক রক্ষা হয়–চাতুরী করতে গেলে হয় না। তাঁর মধ্যেই দুই লোক আছে। তাঁর মধ্যেই যদি আমাকে পাই তবে একসঙ্গেই তাঁকেও পাই আমাকেও পাই। আর তাঁর সঙ্গে যদি ভাগ বিভাগ করে সীমানা টেনে পাকা দলিল করে নিয়ে কাজ চালাতে চাই তা হলে সেটা একেবারেই পাকা কাজ হয় না, সেটা বিষয়কর্মের নামান্তর হয়। বিষয়কর্মের যে গতি তারও সেই গতি–অর্থাৎ তার মধ্যে নিত্যতার লক্ষণ নেই–তার মধ্যে বিকার আসে এবং ক্রমে মৃত্যু দেখা দেয়।
ও-সমস্ত চাতুরী ছেড়ে দিয়ে ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে হবে এই কথাটাকেই পাকা করা যাক। আমার দুইয়ে কাজ নেই, আমার একই ভালো। আমার অন্তরাত্মার মধ্যে একটি সতীর লক্ষণ আছে, সে চতুরা নয়, সে যথার্থই দুইকে চায় না, সে এককেই চায়; যখন সে এককে পায় তখনই সে সমস্তকেই পায়।