নৌকাডুবি
ভাবে নাই এমন নহে। এই পীড়ায় যদি অবশেষে তাহার মৃত্যু ঘটে, তবে আসন্ন মৃত্যুকালে সেই চিকিৎসকের পায়ের ধুলা লইয়া সে মরিতে পারিবে, ইহাও সে চোখ বুজিয়া কল্পনা করিতেছিল।

রাত্রে নবীনকালী কমলাকে আপনার ঘরে লইয়া শুইলেন। পরদিন স্টেশনে যাইবার সময় নিজের গাড়ির মধ্যে তুলিয়া লইলেন। কর্তা মুকুন্দবাবু রেলগাড়িতে সেকেণ্ড্‌ ক্লাসে উঠিলেন, নবীনকালী বামুন-ঠাকরুনকে লইয়া ইণ্টার্‌মিডিয়েটে স্ত্রীকক্ষে আশ্রয়লাভ করিলেন।

অবশেষে গাড়ি কাশী স্টেশন ছাড়িল; মত্ত হস্তী যেমন করিয়া লতা ছিঁড়িয়া লয়, তেমনি করিয়া রেলগাড়ি গর্জন করিতে করিতে কমলাকে ছিঁড়িয়া লইয়া চলিয়া গেল। কমলা ক্ষুধিতচক্ষে জানলা হইতে বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। নবীনকালী কহিলেন, “বামুন-ঠাকরুন, পানের ডিপেটা কোথায় রাখিলে?”

কমলা পানের ডিপেটা বাহির করিয়া দিল। ডিপে খুলিয়া নবীনকালী কহিলেন, “এই দেখো, যা ভাবিয়াছিলাম, তাই হইয়াছে। চুনের কৌটোটা ফেলিয়া আসিয়াছ? এখন আমি করি কী। যেটি আমি নিজে না দেখিব সেটিতে একটা-না-একটা গলদ হইয়া আছেই। এ কিন্তু বামুন-ঠাকরুন, তুমি শয়তানি করিয়া করিয়াছ। কেবল আমাকে জব্দ করিবার মতলবে। ইচ্ছা করিয়া আমাদের হাড় জ্বালাইতেছ। আজ তরকারিতে নুন নাই, কাল পায়েসে ধরা গন্ধ— মনে করিতেছ, এ-সমস্ত চালাকি আমরা বুঝি না। আচ্ছা, চলো মিরাটে, তার পরে দেখা যাইবে তুমিই বা কে আর আমিই বা কে।”

গাড়ি যখন পুলের উপর দিয়া চলিল, কমলা জানলা হইতে মুখ বাড়াইয়া গঙ্গা-তীরবর্তী কাশী শহরটা একবার দেখিয়া লইল। ঐ শহরের মধ্যে কোন্‌ দিকে যে নলিনাক্ষের বাড়ি তাহা সে কিছুই জানে না। এইজন্য রেলগাড়ির দ্রুতধাবনের মধ্যে ঘাট, বাড়ি, মন্দিরচূড়া যাহা-কিছু তাহার চক্ষে পড়িল, সমস্তই নলিনাক্ষের আবির্ভাবের দ্বারা মণ্ডিত হইয়া তাহার হৃদয়কে স্পর্শ করিল।

নবীনকালী কহিলেন, “ওগো, অত করিয়া ঝুঁকিয়া দেখিতেছ কী? তুমি তো পাখি নও, তোমার ডানা নাই যে উড়িয়া যাইবে।”

কাশী নগরীর চিত্র কোথায় আচ্ছন্ন হইয়া গেল। কমলা স্থিরনীরব হইয়া বসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল।

অবশেষে গাড়ি মোগলসরাইয়ে থামিল। কমলার কাছে স্টেশনের গোলমাল, লোকজনের ভিড়, সমস্তই ছায়ার মতো, স্বপ্নের মতো বোধ হইতে লাগিল। সে কলের পুতলির মতো এক গাড়ি হইতে অন্য গাড়ি উঠিল।

গাড়ি ছাড়িবার সময় হইয়া আসিতেছে, এমন সময় কমলা হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া শুনিতে পাইল তাহাকে কে পরিচিত কণ্ঠে “মা” বলিয়া ডাকিয়া উঠিয়াছে। কমলা প্ল্যাট্‌ফর্মের দিকে মুখ ফিরাইয়া দেখিল— উমেশ।

কমলার সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল; “কহিল, কী রে উমেশ!”

উমেশ গাড়ির দরজা খুলিয়া দিল এবং মুহূর্তের মধ্যে কমলা নামিয়া পড়িল। উমেশ তৎক্ষণাৎ ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া কমলার পায়ের ধুলা মাথায় তুলিয়া লইল। তাহার সমস্ত মুখ আকর্ণপ্রসারিত হাসিতে ভরিয়া গেল।

পরক্ষণেই গার্ড কামরার দরজা বন্ধ করিয়া দিল। নবীনকালী চেঁচামেচি করিতে লাগিলেন, “বামুন-ঠাকরুন, করিতেছ কী! গাড়ি ছাড়িয়া দেয় যে! ওঠো, ওঠো!”

কমলার কানে সে কথা পৌঁছিলই না। গাড়িও বাঁশি ফুঁকিয়া দিয়া গস্‌গস্‌ শব্দে স্টেশন হইতে বাহির হইয়া গেল।

কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশ, তুই কোথা হইতে আসিতেছিস?”

উমেশ কহিল, “গাজিপুর হইতে।”

কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “সেখানে সকলে ভালো আছেন তো? খুড়ামশায়ের কী খবর?”