প্রতিশব্দ
‘সহানুভূতি’ বলিয়া একটা বিকট শব্দ জোর করিয়া বানাইতে হইয়াছে; এই গুরুভার শব্দটা ভীমের গদার মতো, ইহাকে লইয়া সর্বদা সাধারণ কাজে ব্যবহার করিতে গেলে বড়োই অসংগত হয়।

দরদ কথাটা ঘর-গড়া নয়, ইহা সজীব, এইজন্য ইহার ব্যবহারের বৈচিত্র্য আছে। ‘লোকটা দরদী’ বলিলেই কথাটার ভাব বুঝিতে বিলম্ব হয় না—কিন্তু ‘লোকটা সহানুভব’ বলিলে কী যে বলা হইল বোঝাই যায় না, যদিচ মহানুভব কথাটা চলিত আছে। আমরা বলি, ‘ওস্তাদজি দরদ দিয়া গান করেন’, ইংরেজিতে এ স্থলে sympathy শব্দের ব্যবহার আছে কিন্তু ‘সহানুভূতি দিয়া গান করেন’ বলিলে মনে হয় যেন ওস্তাদজি গানের প্রতি বিষম একটা অত্যাচার করেন।

আসল কথা, অনুভূতি শব্দটা বাংলায় নূতন আমদানি, এইজন্য উহার’পরে আমাদের দরদ জন্মে নাই। এইজন্যই ‘সহানুভূতি’ শব্দটা শুনিলে আমাদের হৃদয় তখনি সাড়া দেয় না। এই কথাটা কাব্যে, এমন-কি, মেঘনাদবধের সমান ওজন কোনো মহাকাব্যেও, ব্যবহার করিতে পারেন এমন দুঃসাহসিক কেহ নাই। অনুভূতি কথাটা যেমন নূতন, বেদনা কথাটা তেমনি পুরাতন। এইজন্য সমবেদনা কথাটা কানে বাজে না। যেখানে দরদ শব্দটা খাপ খায় না সেখানে আমি ‘সমবেদনা’ শব্দ ব্যবহার করি, পারৎপক্ষে ‘সহানুভূতি’ ব্যবহার করি না।

তর্জমা করিবার সময় একটা জিনিস আমরা প্রায় ভুলিয়া যাই। প্রত্যেক ভাষায় এমন কোনো কোনো শব্দ থাকে যাহার নানা অর্থ আছে। আমাদের ‘ভাব’ কথাটা, কোথাও বা idea,কোথাও বা thought, কোথাও বা feeling, কোথাও বা suggestion, কোথাও বা gist। ভাব কথাটাকে ইংরেজিতে তর্জমা করিবার সময়ে সকল জায়গাতেই যদি idea শব্দ প্রয়োগ করি তবে তাহা অদ্ভুত হইবে। ‘এই প্রস্তাবের সহিত আমাদের সহানুভূতি আছে’ এরূপ বাক্য প্রয়োগ আমরা মাঝে মাঝে শুনিয়াছি। ইহা ইংরেজি ভাষা-ব্যবহারের নকল, কিন্তু বাংলায় ইহা অত্যন্ত অসংগত। এ স্থলে ‘এই প্রস্তাবে আমাদের সম্মতি আছে’ বলা যায়—কারণ, প্রস্তাবের অনুভূতি নাই, সুতরাং তাহার সহিত সহানুভূতি চলে না। অতএব একভাষায় যেখানে একশব্দের দ্বারা নানা অর্থ বোঝায় অন্য ভাষায় তাহার এক প্রতিশব্দ হইতেই পারে না।

গতবারের শান্তিনিকেতনে originally শব্দের আলোচনাস্থলে আমরা ইহার প্রমাণ পাইয়াছি। কোনো একজন মানুষের originally আছে এই ভাব ব্যক্ত করিবার সময়ে তাঁহার স্বানুবর্তিতা আছে বলা চলে না,সে স্থলে ‘আদিমতা’ আছে বলিলে ঠিক হয়; যে কবিতা হইতে আর-একটি কবিতা তর্জমা করা হইয়াছে সেই কবিতাকে মূল কবিতা বলিতে হইবে। যে কবিতায় বিশেষ অসামান্যতা আছে, তাহাকে অনন্যতন্ত্র কবিতা বলা চলে। ইহার উপযুক্ত সংস্কৃত কথাটি ‘স্বতন্ত্র’—কিন্তু বাংলায় অন্য অর্থে তাহার ব্যবহার। বস্তুত আমার মনে হয়, কি মানুষ সম্বন্ধে, কি মানুষের রচনা সম্বন্ধে, উভয় স্থলেই অনন্যতন্ত্র শব্দের ব্যবহার চলিতে পারে।

একটি অত্যন্ত সহজ কথা লইয়া বাংলা ভাষায় আমাদিগকে প্রায় দুঃখ পাইতে হয়—সে কথাটি feeling। Feeling-এর একটা অর্থ বোধশক্তি—ইহাকে আমরা ‘অনুভূতি’ শব্দের দ্বারা প্রকাশ করিতেছি। আর-একটি অর্থ হৃদয়বৃত্তি। কিন্তু হৃদয়বৃত্তি শব্দটা পারিভাষিক। সর্বদা ব্যবহারে ইহা চলিতে পারে না। অনেক সময়ে কেবলমাত্র ‘হৃদয়’ শব্দের দ্বারা কাজ চালানো যায়; যেখানে ইংরেজিতে বলে ‘feeling উত্তেজিত হইয়াছে’ সেখানে বাংলায় বলা চলে, ‘হৃদয়’ উত্তেজিত হইয়াছে। যে মানুষের feelingআছে তাহাকে সহৃদয় বলি। ‘কবি এই কবিতায় যে feelingপ্রকাশ করিয়াছে’ এরূপ স্থলে feeling-এর প্রতিশব্দ স্বরূপে হৃদয়ভাব বলা যায়। শুধু ‘ভাব’ও অনেক সময়ে feeling-এর প্রতিশব্দরূপে চলে। Emotion শব্দটি বাংলায় তর্জমা করিবার সময় আমি বরাবর ‘আবেগ’ ও হৃদয়াবেগ’ শব্দ ব্যবহার করিয়া আসিয়াছি। যাঁহারা সংস্কৃত জানেন তাঁহাদের কাছে আমার প্রশ্ন এই যে, সংস্কৃত ভাষায় পারিভাষিক ও সহজ অর্থে ‘feeling’ শব্দের কোন্‌ কোন্‌ প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়?

ইংরেজি culture শব্দের বাংলা লইয়া অনেক সময় ঠেকিতে হয়। ‘learning’ এবং ‘culture’ শব্দের মধ্যে যে পার্থক্য