ভাষার কথা
বদলে ‘ তেঁহ ' লিখিত। এক সময়ে ‘ আমারদিগের ' শব্দটা শুদ্ধ বলিয়া গণ্য ছিল, এখন ‘ আমাদের ' লিখিতে কারো হাত কাঁপে না। আগে যেখানে লিখিতাম ‘ সেহ ' এখন সেখানে লিখি ‘ সেও ', অথচ পণ্ডিতের ভয়ে ‘ কেহ ' কে ‘ কেও ' অথবা ‘ কেউ ' লিখিতে পারি না। ভবিষ্যৎবাচক ‘ করিহ ' শব্দটাকে ‘ করিয়ো ' লিখিতে সংকোচ করি না, কিন্তু তার বেশি আর একটু অগ্রসর হইতে সাহস হয় না।

এই তো আমরা পণ্ডিতের ভয়ে সতর্ক হইয়া চলি কিন্তু পণ্ডিত যখন পুঁথির বাংলা বানাইয়াছিলেন আমাদের কিছুমাত্র খাতির করেন নাই। বাংলা গদ্য-পুঁথিতে যখন তাঁরা ‘ যাইয়াছি ' ‘ যাইল ' কথা চালাইয়া দিলেন তখন তাঁরা ক্ষণকালের জন্যও চিন্তা করেন নাই যে, এই ক্রিয়াপদটি একেবারে বাংলাই নয়। যা ধাতু বাংলায় কেবলমাত্র বর্তমান কালেই চলে ; যথা, যাই, যাও, যায়। আর, ‘ যাইতে ' শব্দের যোগে যে-সকল ক্রিয়াপদ নিষ্পন্ন হয় তাহাতেও চলে ; যেমন, ‘ যাচ্চি ' ‘ যাচ্ছিল ' ইত্যাদি। কিন্তু ‘ যেল ' ‘ যেয়েছি ' ‘ যেয়েছিলুম ' পণ্ডিতদের ঘরেও চলে না। এ স্থলে আমরা বলি ‘ গেল ' ‘ গিয়েছি ' ‘ গিয়েছিলুম '। তার পরে পণ্ডিতেরা ‘ এবং ' বলিয়া এক অদ্ভুত অব্যয় শব্দ বাংলার স্কন্ধে চাপাইয়াছেন এখন তাহাকে ঝাড়িয়া ফেলা দায়। অথচ সংস্কৃত বাক্যরীতির সঙ্গে এই শব্দ ব্যবহারের যে মিল আছে তাও তো দেখি না। বর ' সংস্কৃত ‘ অপর ' শব্দের আত্মজ যে ‘ আর ' শব্দ সাধারণে ব্যবহার করিয়া থাকে তাহা শুদ্ধরীতিসংগত। বাংলায় ‘ ও ' বলিয়া একটা অব্যয় শব্দ আছে তাহা সংস্কৃত অপি শব্দের বাংলা রূপ। ইহা ইংরেজি ‘and' শব্দের প্রতিশব্দ নহে, too শব্দের প্রতিশব্দ। আমরা বলি আমিও যাব তুমিও যাবে — কিন্তু কখনো বলি না ‘ আমি ও তুমি যাব '। সংস্কৃতের ন্যায় বাংলাতেও আমরা সংযোজক শব্দ ব্যবহার না করিয়া দ্বন্দ্বসমাস ব্যবহার করি। আমরা বলি ‘ বিছানা বালিশ মশারি সঙ্গে নিয়ো '। যদি ভিন্ন শ্রেণীয় পদার্থের প্রসঙ্গ করিতে হয় তবে বলি ‘ বিছানা বালিশ মশারি আর বাইরের বাক্সটা সঙ্গে নিয়ো '। এর মধ্যে ‘ এবং ' কিংবা ‘ ও ' কোথাও স্থান পায় না। কিন্তু পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার আইনকে আমল দেন নাই। আমি এই যে দৃষ্টান্তগুলি দেখাইতেছি তার মতলব এই যে, পণ্ডিতমশায় যদি সংস্কৃতরীতির উপর ভর দিয়া বাংলারীতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারেন, তবে আমরাই বা কেন বাংলারীতির উপর ভর দিয়া যথাস্থানে সংস্কৃতরীতিকে লঙ্ঘন করিতে সংকোচ করি? ‘ মনোসাধে ' আমাদের লজ্জা কিসের? ‘ সাবধানী ' বলিয়া তখনি জিব কাটিতে যাই কেন? এবং ‘ আশ্চর্য হইলাম ' বলিলে পণ্ডিতমশায় ‘ আশ্চর্যান্বিত হয়েন ' কী কারণে?

আমি যে-কথাটা বলিতেছিলাম সে এই—যখন লেখার ভাষার সঙ্গে মুখের ভাষার অসামঞ্জস্য থাকে তখন স্বভাবের নিয়ম অনুসারেই এই দুই ভাষার মধ্যে কেবলই সামঞ্জস্যের চেষ্টা চলিতে থাকে। ইংরেজি-গদ্যসাহিত্যের প্রথম আরম্ভে অনেকদিন হইতেই এই চেষ্টা চলিতেছিল। আজ তার কথায় লেখায় সামঞ্জস্য ঘটিয়াছে বলিয়াই উভয়ে একটা সাম্যদশায় আসিয়াছে। আমাদের ভাষায় এই অসামঞ্জস্য প্রবল সুতরাং স্বভাব আপনি উভয়ের ভেদ ঘুচাইবার জন্য ভিতরে ভিতরে আয়োজন করিতেছিল। এমন সময় হঠাৎ আইনকর্তার প্রাদুর্ভাব হইল। তাঁরা বলিলেন লেখার ভাষা আজ যেখানে আসিয়া পৌছিয়াছে ইহার বেশি আর তার নড়িবার হুকুম নাই।

‘সবুজ পত্র’-সম্পাদক বলেন বেচারা পুঁথির ভাষার প্রাণ কাঁদিতেছে কথায় ভাষার সঙ্গে মালা বদল করিবার জন্য। গুরুজন ইহার প্রতিবাদী। তিনি ঘটকালি করিয়া কৌলীন্যের নির্মম শাসন ভেদ করিবেন এবং শুভ বিবাহ ঘটাইয়া দিবেন—কারণ কথা আছে শুভস্য শীঘ্রং।

যাঁরা প্রতিবাদী তাঁরা এই বলিয়া তর্ক করেন যে, বাংলায় চলিত ভাষা নানা জিলায় নানা ছাঁচের, তবে কি বিদ্রোহীর দল একটা অরাজকতা ঘটাইবার চেষ্টায় আছে! ইহার উত্তর এই যে, যে যেমন খুশি আপন প্রাদেশিক ভাষায় পুঁথি লিখিবে, চলিত ভাষায় লিখিবার এমন অর্থ নয়। প্রথমত খুশিরও একটা কারণ থাকা চাই। কলিকাতার উপর রাগ করিয়া বীরভূমের লোক বীরভূমের