সাহিত্যতত্ত্ব
অনুভূতি সহজ আরামবোধের চেয়ে প্রবলতর। ট্রাজেডির মূল্য এই নিয়ে। কৈকেয়ীর প্ররোচনায় রামচন্দ্রের নির্বাসন, মন্থরার উল্লাস, দশরথের মৃত্যু, এর মধ্যে ভালো কিছুই নেই। সহজ ভাষায় যাকে আমরা সুন্দর বলি এ ঘটনা তার সমশ্রেণীর নয়, এ কথা মানতেই হবে। তবু এই ঘটনা নিয়ে কত কাব্য নাটক ছবি গান পাঁচালি বহুকাল থেকে চলে আসছে; ভিড় জমছে কত; আনন্দ পাচ্ছে সবাই। এতেই আছে বেগবান অভিজ্ঞতায় ব্যক্তিপুরুষের প্রবল আত্মানুভূতি। বদ্ধ জল যেমন বোবা, গুমট হাওয়া যেমন আত্মপরিচয়হীন, তেমনি প্রাত্যহিক আধমরা অভ্যাসের একটানা আবৃত্তি ঘা দেয় না চেতনায়, তাতে সত্তাবোধ নিস্তেজ হয়ে থাকে। তাই দুঃখে বিপদে বিদ্রোহে বিপ্লবে অপ্রকাশের আবেশ কাটিয়ে মানুষ আপনাকে প্রবল আবেগে উপলব্ধি করতে চায়।

একদিন এই কথাটি আমার কোনো একটি কবিতায় লিখেছিলেম। বলেছিলেম, আমার অন্তরতম আমি আলস্যে আবেশে বিলাসের প্রশ্রয়ে ঘুমিয়ে পড়ে; নির্দয় আঘাতে তার অসাড়তা ঘুচিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলে তবেই সেই আমার আপনাকে নিবিড় ক’রে পাই, সেই পাওয়াতেই আনন্দ।

এত কাল আমি রেখেছিনু তারে যতনভরে

       শয়ন-’পরে;

ব্যথা পাছে লাগে, দুখ পাছে জাগে,

নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে

বাসরশয়ন করেছি রচন কুসুমথরে,

দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে গোপন ঘরে।

       যতনভরে।

শেষে       সুখের শয়নে শ্রান্ত পরান আলসরসে

       আবেশবশে।

পরশ করিলে জাগে না সে আর,

কুসুমের হার লাগে গুরুভার,

ঘুমে জাগরণে মিশি একাকার নিশিদিবসে;

বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ মরমে পশে

       আবেশবশে।

তাই       ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে নূতন খেলা

       রাত্রিবেলা।

মরণদোলায় ধরি রশিগাছি

বসিব দুজনে বড়ো কাছাকাছি,

ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া মারিবে ঠেলা,

প্রাণেতে আমাতে খেলিব দুজনে ঝুলন-খেলা

       নিশীথ বেলা।

আমাদের শাস্ত্র বলেন—

তং বেদ্যং পুরুষং বেদ যথা মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথাঃ।