নৌকাডুবি

বক্তৃতাসভা হইতে ফিরিবার সময় যোগেন্দ্র কহিল, “অক্ষয়, তুমি বেশ পাত্রটি সন্ধান করিয়াছ যা হোক। এ তো সন্ন্যাসী! এর অর্ধেক কথা তো আমি বুঝিতেই পারিলাম না।”

অক্ষয় কহিল, “রোগীর অবস্থা বুঝিয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিতে হয়। হেমনলিনী রমেশের ধ্যানে মগ্ন আছেন; সে ধ্যান সন্ন্যাসী নহিলে আমাদের মতো সহজ লোকে ভাঙাইতে পারিবে না। যখন বক্তৃতা চলিতেছিল তখন তুমি কি হেমের মুখ লক্ষ্য করিয়া দেখ নাই?”

যোগেন্দ্র। দেখিয়াছি বৈকি। ভালো লাগিতেছিল তাহা বেশ বুঝা গেল। কিন্তু বক্তৃতা ভালো লাগিলেই যে বক্তাকে বরমাল্য দেওয়া সহজ হয়, তাহার কোনো হেতু দেখি না।

অক্ষয়। ঐ বক্তৃতা কি আমাদের মতো কাহারো মুখে শুনিলে ভালো লাগিত? তুমি জান না যোগেন্দ্র, তপস্বীর উপর মেয়েদের একটা বিশেষ টান আছে। সন্ন্যাসীর জন্য উমা তপস্যা করিয়াছিলেন, কালিদাস তাহা কাব্যে লিখিয়া গেছেন। আমি তোমাকে বলিতেছি, আর যে-কোনো পাত্র তুমি খাড়া করিবে হেমনলিনী রমেশের সঙ্গে মনে মনে তাহার তুলনা করিবে; সে তুলনায় কেহ টিঁকিতে পারিবে না। নলিনাক্ষ মানুষটি সাধারণ লোকের মতোই নয়; ইহার সঙ্গে তুলনার কথা মনেই উদয় হইবে না। অন্য কোনো যুবককে হেমনলিনীর সম্মুখে আনিলেই তোমাদের উদ্দেশ্য সে স্পষ্ট বুঝিতে পারিবে এবং তাহার সমস্ত হৃদয় বিদ্রোহী হইয়া উঠিবে। কিন্তু নলিনাক্ষকে বেশ একটু কৌশল করিয়া যদি এখানে আনিতে পার তাহা হইলে হেমের মনে কোনো সন্দেহ উঠিবে না; তাহার পরে ক্রমে শ্রদ্ধা হইতে মাল্যদান পর্যন্ত কোনোপ্রকারে চালনা করিয়া লইয়া যাওয়া নিতান্ত শক্ত হইবে না।

যোগেন্দ্র। কৌশলটা আমার দ্বারা ভালো ঘটিয়া ওঠে না— বলটাই আমার পক্ষে সহজ। কিন্তু যাই বল পাত্রটি আমার পছন্দ হইতেছে না।

অক্ষয়। দেখো যোগেন, তুমি নিজের জেদ লইয়া সমস্ত মাটি করিয়ো না। সকল সুবিধা একত্রে পাওয়া যায় না। যেমন করিয়া হোক, রমেশের চিন্তা হেমনলিনীর মন হইতে না তাড়াইতে পারিলে আমি তো ভালো বুঝি না। তুমি যে গায়ের জোরে সেটা করিয়া উঠিতে পারিবে, তাহা মনেও করিয়ো না। আমার পরামর্শ অনুসারে যদি ঠিকমত চল তাহা হইলে তোমাদের একটা সদ্‌গতি হইতেও পারে।

যোগেন্দ্র। আসল কথা, নলিনাক্ষ আমার পক্ষে একটু বেশি দুর্বোধ। এরকম লোকদের লইয়া কারবার করিতে আমি ভয় করি। একটা দায় হইতে উদ্ধার হইতে গিয়া ফের আর-একটা দায়ের মধ্যে জড়াইয়া পড়িব।

অক্ষয়। ভাই, তোমরা নিজের দোষে পুড়িয়াছ, আজকে সিঁদুরে মেঘ দেখিয়া আতঙ্ক লাগিতেছে। রমেশ সম্বন্ধে তোমরা যে গোড়াগুড়ি একেবারে অন্ধ ছিলে। এমন ছেলে আর হয় না, ছলনা কাহাকে বলে রমেশ তাহা জানে না, দর্শনশাস্ত্রে রমেশ দ্বিতীয় শংকরাচার্য বলিলেই হয়, আর সাহিত্যে স্বয়ং সরস্বতীর ঊনবিংশ শতাব্দীর পুরুষ-সংস্করণ! রমেশকে প্রথম হইতেই আমার ভালো লাগে নাই— ঐরকম অত্যুচ্চ-আদর্শ-ওয়ালা লোক আমার বয়সে আমি ঢের-ঢের দেখিয়াছি। কিন্তু আমার কথাটি কহিবার জো ছিল না; তোমরা জানিতে, আমার মতো অযোগ্য অভাজন কেবল মহাত্মা-লোকদের ঈর্ষা করিতেই জানে, আমাদের আর কোনো ক্ষমতা নাই। যা হোক, এতদিন পরে বুঝিয়াছ মহাপুরুষদের দূর হইতে ভক্তি করা চলে, কিন্তু তাঁহাদের সঙ্গে নিজের বোনের বিবাহের সম্বন্ধ করা নিরাপদ নহে। কিন্তু কণ্টকেনৈব কন্টকম্‌। যখন এই একটিমাত্র উপায় আছে, তখন আর এ লইয়া খুঁত খুঁত করিতে বসিয়ো না।

যোগেন্দ্র। দেখো অক্ষয়, তুমি যে আমাদের সকলের আগে রমেশকে চিনিতে পারিয়াছিলে, এ কথা হাজার বলিলেও আমি বিশ্বাস করিব না। তখন নিতান্ত গায়ের জ্বালায় তুমি রমেশকে দু চক্ষে দেখিতে পারিতে না; সেটা যে তোমার অসাধারণ বুদ্ধির