নৌকাডুবি
পরিচয় তাহা আমি মানিব না। যাই হোক, কলকৌশলের যদি প্রয়োজন থাকে তবে তুমি লাগো, আমার দ্বারা হইবে না। মোটের উপরে, নলিনাক্ষকে আমার ভালোই লাগিতেছে না।

যোগেন্দ্র এবং অক্ষয় উভয়ে যখন অন্নদার চা খাইবার ঘরে আসিয়া পৌঁছিল, দেখিল, হেমনলিনী ঘরের অন্য দ্বার দিয়া বাহির হইয়া যাইতেছে। অক্ষয় বুঝিল, হেমনলিনী তাহাদিগকে জানালা দিয়া পথেই দেখিতে পাইয়াছিল। ঈষৎ একটু হাসিয়া সে অন্নদার কাছে আসিয়া বসিল। চায়ের পেয়ালা ভর্তি করিয়া লইয়া কহিল, “নলিনাক্ষবাবু যাহা বলেন একেবারে প্রাণের ভিতর হইতে বলেন, সেইজন্য তাঁহার কথাগুলা এত সহজে প্রাণের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করে।”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “লোকটির ক্ষমতা আছে।”

অক্ষয় কহিল, “শুধু ক্ষমতা! এমন সাধুচরিত্রের লোক দেখা যায় না।”

যোগেন্দ্র যদিও চক্রান্তের মধ্যে ছিল তবু সে থাকিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, “আঃ, সাধুচরিত্রের কথা আর বলিয়ো না; সাধুসঙ্গ হইতে ভগবান আমাদিগকে পরিত্রাণ করুন।”

যোগেন্দ্র কাল এই নলিনাক্ষের সাধুতার অজস্র প্রশংসা করিয়াছিল, এবং যাহারা নলিনাক্ষের বিরুদ্ধে কথা কহে তাহাদিগকে নিন্দুক বলিয়া গালি দিয়াছিল।

অন্নদা কহিলেন, “ছি যোগেন্দ্র, অমন কথা বলিয়ো না। বাহির হইতে যাঁহাদিগকে ভালো বলিয়া মনে হয় অন্তরেও তাঁহারা ভালো, এ কথা বিশ্বাস করিয়া বরং আমি ঠকিতে রাজি আছি, তবু নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধিমত্তার গৌরবরক্ষার জন্য সাধুতাকে সন্দেহ করিতে আমি প্রস্তুত নই। নলিনাক্ষবাবু যে-সব কথা বলিয়াছেন এ-সমস্ত পরের মুখের কথা নহে; তাঁহার নিজের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ভিতর হইতে তিনি যাহা প্রকাশ করিয়াছেন আমার পক্ষে আজ তাহা নূতন লাভ বলিয়া মনে হইয়াছে। যে ব্যাক্তি কপট সে ব্যক্তি সত্যকার জিনিস দিবে কোথা হইতে? সোনা যেমন বানানো যায় না এ-সব কথাও তেমনি বানানো যায় না। আমার ইচ্ছা হইয়াছে নলিনাক্ষবাবুকে আমি নিজে গিয়া সাধুবাদ দিয়া আসিব।”

অক্ষয় কহিল, “আমার ভয় হয়, ইঁহার শরীর টেঁকে কি না।”

অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “কেন, ইঁহার শরীর কি ভালো নয়?”

অক্ষয়। ভালো থাকিবার তো কথা নয়; দিনরাত্রি আপনার সাধনা এবং শাস্ত্রালোচনা লইয়াই আছেন, শরীরের প্রতি তো আর দৃষ্টি নাই।

অন্নদা কহিলেন, “এটা ভারি অন্যায়। শরীর নষ্ট করিবার অধিকার আমাদের নাই; আমরা আমাদের শরীর সৃষ্টি করি নাই। আমি যদি উঁহাকে কাছে পাইতাম তবে নিশ্চয়ই অল্পদিনেই আমি উঁহার স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করিয়া দিতে পারিতাম। আসলে স্বাস্থ্যরক্ষার গুটিকতক সহজ নিয়ম আছে, তাহার মধ্যে প্রথম হচ্ছে— ”

যোগেন্দ্র অধৈর্য হইয়া কহিল, “বাবা, বৃথা কেন তোমরা ভাবিয়া মরিতেছ? নলিনাক্ষবাবুর শরীর তো দিব্য দেখিলাম; তাঁহাকে দেখিয়া আজ আমার বেশ বোধ হইল, সাধুত্ব-জিনিসটা স্বাস্থ্যকর। আমার নিজেরই মনে হইতেছে, ওটা চেষ্টা করিয়া দেখিলে হয়।”

অন্নদা কহিলেন, “না যোগেন্দ্র, অক্ষয় যাহা বলিতেছে তাহা হইতেও পারে। আমাদের দেশে বড়ো বড়ো লোকেরা প্রায় অল্প বয়সেই মারা যান, ইঁহারা নিজের শরীরকে উপেক্ষা করিয়া দেশের লোকসান করিয়া থাকেন। এটা কিছুতে ঘটিতে দেওয়া উচিত নয়। যোগেন্দ্র, তুমি নলিনাক্ষবাবুকে যাহা মনে করিতেছ তাহা নয়, উঁহার মধ্যে আসল জিনিস আছে। উঁহাকে এখন হইতেই সাবধান করিয়া দেওয়া দরকার।”