পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি
পিছিয়ে, কলের সঙ্গে সে তাল রাখতে পারে না। য়ুরোপে সেই মানুষ-ব্যক্তিটি দিনে দিনে বহু দূরে পড়ে গেল; কল গেল এগিয়ে; তাকেই সেখানকার লোকে বলে অগ্রসরতা, প্রোগ্রেস্‌।

সিদ্ধি, যাকে ইংরেজিতে বলে সাক্‌সেস্‌, তার বাহন যত দৌড়ে চলে ততই ফল পায়। য়ুরোপের দেশে দেশে রাষ্ট্রনীতির যুদ্ধনীতির বাণিজ্যনীতির তুমুল ঘোড়দৌড় চলছে জলে স্থলে আকাশে। সেখানে বাহ্য প্রয়োজনের গরজ অত্যন্ত বেশি হয়ে উঠল, তাই মনুষ্যত্বের ডাক শুনে কেউ সবুর করতে পারছে না। বীভৎস সর্বভুক্‌ পেটুকতার উদ্যোগে পলিটিক্‌স্‌ নিয়ত ব্যস্ত। তার গাঁট-কাটা ব্যবসায়ের পরিধি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বকালে যুদ্ধবিগ্রহের পদ্ধতিতে ধর্মবুদ্ধি যেখানে মাঝে মাঝে বাধা খাড়া করে রেখেছিল, ডিপ্লমাসি সেখানে আজ লাফ-মারা হার্ড্‌ল্‌ রেস্‌ খেলে চলেছে। সবুর সয় না যে। বিষবায়ুবাণ যুদ্ধের অস্ত্ররূপে যখন এক পক্ষ ব্যবহার করলে তখন অন্য পক্ষ ধর্মবুদ্ধির দোহাই পাড়লে। আজ সকল পক্ষই বিষের সন্ধানে উঠে পড়ে লেগেছে; যুদ্ধকালে নিরস্ত্র পুরবাসীদের প্রতি আকাশ থেকে অগ্নিবাণ বর্ষণ নিয়ে প্রথমে শোনা গেল ধর্মবুদ্ধির নিন্দাবাণী। আজ দেখি, ধার্মিকেরা স্বয়ং সামান্য কারণে পল্লীবাসীদের প্রতি কথায় কথায় পাপবজ্র সন্ধান করছে। গত যুদ্ধের সময় শত্রুর সম্বন্ধে নানা উপায়ে সজ্ঞানে সচেষ্টভাবে সত্যগোপন ও মিথ্যা-প্রচারের শয়তানি অস্ত্র ব্যবহার প্রকাণ্ডভাবে চলল। যুদ্ধ থেমেছে কিন্তু সেই শয়তানি আজও থামে নি। এমন কি, অক্ষম ভারতবর্ষকেও প্রবলের প্রপাগাণ্ডা রেয়াত করে না। এইসব নীতি হচ্ছে সবুর-না-করা নীতি; এরা হল পাপের দ্রুত চাল; এরা প্রতি পদেই বাহিরে জিতছে বটে কিন্তু সে জিত অন্তরের মানুষকে হারিয়ে দিয়ে। মানুষ আজ নিজের মাথা থেকে জয়মাল্য খুলে নিয়ে কলের গলায় পরিয়ে দিলে। রসাতল থেকে দানব বলছে, “বাহবা!”-

রথীরে কহিল গৃহী উৎকণ্ঠায় ঊর্ধ্বস্বরে ডাকি,

“ থামো, থামো, কোথা তুমি রুদ্রবেগে রথ যাও হাঁকি,

সম্মুখে আমার গৃহ। ”

রথী কহে, “ ওই মোর পথ,

ঘুরে গেলে দেরি হবে, বাধা ভেঙে সিধা যাবে রথ। ”

গৃহী কহে, “ নিদারুণ ত্বরা দেখে মোর ডর লাগে-

কোথা যেতে হবে বলো। ”

রথী কহে, “ যেতে হবে আগে। ”

“ কোন্‌খানে ” শুধাইল।

রথী বলে, “ কোনোখানে নহে,

শুধু আগে। ”

“ কোন্‌ তীর্থে, কোন্‌ সে মন্দিরে ” গৃহী কহে।

“ কোথাও না, শুধু আগে। ”

“ কোন্‌ বন্ধু সাথে হবে দেখা। ”

“ কারো সাথে নহে, যাব সব আগে আমি মাত্র একা। ”

ঘর্ঘরিত রথবেগ গৃহভিত্তি করি দিল গ্রাস ;

হাহাকারে, অভিশাপে, ধূলিজালে ক্ষুভিল বাতাস

সন্ধ্যার আকাশে! আঁধারের দীপ্ত সিংহদ্বার-বাগে

রক্তবর্ণ অস্তপথে ছোটে রথ লক্ষ্যশূন্য আগে।