নৌকাডুবি
স্বামীর সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া চলিতে লাগিলেন— বলা বাহুল্য, ইহা রাজবল্লভের পক্ষে সুখকর হয় নাই। তাঁহার ছেলে নলিনাক্ষ ধর্মপ্রচারের উৎসাহে ও বক্তৃতাশক্তিদ্বারা উপযুক্ত বয়সে ব্রাহ্মসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেন। তিনি সরকারি ডাক্তারের কাজে বাংলার নানা স্থানে অবস্থিতি করিয়া চরিত্রের নির্মলতা, চিকিৎসার নৈপুণ্য ও সৎকর্মের উদ্‌‌যোগে সর্বত্র খ্যাতি বিস্তার করিতে থাকেন।

ইতিমধ্যে একটি অভাবনীয় ব্যাপার ঘটিল। বৃদ্ধ বয়সে রাজবল্লভ একটি বিধবাকে বিবাহ করিবার জন্য হঠাৎ উন্মত্ত হইয়া উঠিলেন। কেহই তাঁহাকে নিরস্ত করিতে পারিল না। রাজবল্লভ বলিতে লাগিলেন, “আমার বর্তমান স্ত্রী আমার যথার্থ সহধর্মিণী নহে; যাহার সঙ্গে ধর্মে মতে ব্যবহারে ও হৃদয়ে মিল হইয়াছে তাহাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ না করিলে অন্যায় হইবে।” এই বলিয়া রাজবল্লভ সর্বসাধারণের ধিক্কারের মধ্যে সেই বিধবাকে অগত্যা হিন্দুমতানুসারে বিবাহ করিলেন।

ইহার পরে নলিনাক্ষের মা গৃহত্যাগ করিয়া কাশী যাইতে প্রবৃত্ত হইলে নলিনাক্ষ রংপুরের ডাক্তারি ছাড়িয়া আসিয়া কহিল, “মা, আমিও তোমার সঙ্গে কাশী যাইব।”

মা কাঁদিয়া কহিলেন, “বাছা, আমার সঙ্গে তোদের তো কিছুই মেলে না, কেন মিছামিছি কষ্ট পাইবি?”

নলিনাক্ষ কহিল, “তোমার সঙ্গে আমার কিছুই অমিল হইবে না।”

নলিনাক্ষ তাহার এই স্বামীপরিত্যক্ত অবমানিত মাতাকে সুখী করিবার জন্য দৃঢ়সংকল্প হইল। তাঁহার সঙ্গে কাশী গেল। মা কহিলেন, “বাবা, ঘরে কি বউ আসিবে না?”

নলিনাক্ষ বিপদে পড়িল, কহিল, “কাজ কী মা, বেশ আছি।”

মা বুঝিলেন, নলিন অনেকটা ত্যাগ করিয়াছে, কিন্তু তাই বলিয়া ব্রাহ্মপরিবারের বাহিরে বিবাহ করিতে প্রস্তুত নহে। ব্যথিত হইয়া তিনি কহিলেন, “বাছা, আমার জন্যে তুই চিরজীবন সন্ন্যাসী হইয়া থাকিবি, এ তো কোনোমতেই হইতে পারে না। তোর যেখানে রুচি তুই বিবাহ কর বাবা, আমি কখনো আপত্তি করিব না।”

নলিন দুই-এক দিন একটু চিন্তা করিয়া কহিল, “তুমি যেমন চাও আমি তেমনি একটি বউ আনিয়া তোমার দাসী করিয়া দিব; তোমার সঙ্গে কোনো বিষয়ে অমিল হইবে, তোমাকে দুঃখ দিবে, এমন মেয়ে আমি কখনোই ঘরে আনিব না।”

এই বলিয়া নলিন পাত্রীর সন্ধানে বাংলাদেশে চলিয়া আসিয়াছিলেন। তাহার পরে মাঝখানে ইতিহাসে একটুখানি বিচ্ছেদ আছে। কেহ বলে, গোপনে সে এক পল্লীতে গিয়া কোন্‌ এক অনাথাকে বিবাহ করিয়াছিল এবং বিবাহের পরেই তাহার স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছিল। কেহ বা তাহাতে সন্দেহ প্রকাশ করে। অক্ষয়ের বিশ্বাস এই যে, বিবাহ করিতে আসিয়া শেষ মুহূর্তে সে পিছাইয়াছিল।

যাহাই হউক, অক্ষয়ের মতে, এখন নিশ্চয়ই নলিনাক্ষ যাহাকেই পছন্দ করিয়া বিবাহ করিবে তাহার মা তাহাতে আপত্তি না করিয়া খুশিই হইবেন। হেমনলিনীর মতো অমন মেয়ে নলিনাক্ষ কোথায় পাইবে? আর যাই হউক, হেমের যেরূপ মধুর স্বভাব তাহাতে সে যে তাহার শাশুড়িকে যথেষ্ট ভক্তিশ্রদ্ধা করিয়া চলিবে, কোনোমতেই তাঁহাকে কষ্ট দিবে না, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। নলিনাক্ষ দুদিন ভালো করিয়া হেমকে দেখিলেই তাহা বুঝিতে পারিবেন। অতএব অক্ষয়ের পরামর্শ এই যে, কোনোমতে দুজনের পরিচয় করাইয়া দেওয়া হউক।