প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
এই ত্রিপুররাজ্যের রাজচিহ্নের মধ্যে একটি সংস্কৃতবাক্য অঙ্কিত দেখিয়াছি—‘কিল বিদুর্বীরতাং সারমেকং’—বীর্যকেই সার বলিয়া জানিবে। এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য। পার্লামেন্ট সার নহে, বাণিজ্যতরী সার নহে, বীর্যই সার। এই বীর্য দেশকালপাত্রভেদে নানা আকারে প্রকাশিত হয়—কেহ বা শস্ত্রে বীর, কেহ বা শাস্ত্রে বীর, কেহ বা ত্যাগে বীর, কেহ বা ভোগে বীর, কেহ বা ধর্মে বীর, কেহ বা কর্মে বীর। বর্তমানে আমাদের ভারতবর্ষীয় প্রতিভাকে আমরা পূর্ণ উৎকর্ষের দিকে লইয়া যাইতে পারিতেছি না তাহার কতকগুলি কারণ আছে, কিন্তু সর্বপ্রধান কারণ বীর্যের অভাব। এই বীর্যের দারিদ্রবশত যদি নিজের প্রকৃতিকেই ব্যর্থ করিয়া থাকি তবে বিদেশের অনুকৃতিতে সার্থক করিয়া তুলিব কিসের জোরে?
আমাদের আমবাগানে আজকাল আম ফলে না, বিলাতের আপেল বাগানে প্রচুর আপেল ফলিয়া থাকে। আমরা কি তাই বলিয়া মনে করিব যে, আমগাছগুলা কাটিয়া ফেলিয়া আপেলগাছ রোপণ করিলে তবেই আমরা আশানুরূপ ফললাভ করিব। এই কথা নিশ্চয় জানিতে হইবে, আপেলগাছে যে বেশি ফল ফলিতেছে তাহার কারণ তাহার গোড়ায়, তাহার মাটিতে সার আছে—আমাদের আমবাগানের জমির সার বহুকাল হইল নিঃশেষিত হইয়া গেছে। আপেল পাই না ইহাই আমাদের মূল দুর্ভাগ্য নহে, মাটিতে সার নাই ইহাই আক্ষেপের বিষয়। সেই সার যদি যথেষ্ট পরিমাণে থাকিত তবে আপেল ফলিত না, কিন্তু আম প্রচুর পরিমাণে ফলিত এবং তখন সেই আম্রের সফলতায় আপেলের অভাব লইয়া বিলাপ করিবার কথা আমাদের মনেই হইত না। তখন দেশের আম বেচিয়া অনায়াসে বিদেশের আপেল হাটে কিনিতে পারিতাম, ভিক্ষার ঝুলি সম্বল করিয়া এক রাত্রে পরের প্রসাদে বড়োলোক হইবার দুরাশা মনের মধ্যে বহন করিতে হইত না।
আসল কথা, দেশের মাটিতে সার ফেলিতে হইবে। সেই সার আর-কিছুই নহে—‘কিল বিদুর্বীরতাং সারমেকং’, বীরতাকেই একমাত্র সার বলিয়া জানিবে। ঋষিরা বলিয়াছেন : নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ। এই-যে আত্মা, ইনি বলহীনের দ্বারা লভ্য নহেন। বিশ্বাত্মা-পরমাত্মার কথা ছাড়িয়া দেওয়া যাক—যে ব্যক্তি দুর্বল সে নিজের আত্মাকে পায় না, নিজের আত্মাকে যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ উপলব্ধি না করিয়াছে সে অপর কিছুকেই লাভ করিতে পারে না। য়ুরোপ নিজের আত্মাকে যে পথ দিয়া লাভ করিতেছে সে পথ আমাদের সম্মুখে নাই; কিন্তু যে মূল্য দিয়া লাভ করিতেছে তাহা আমাদের পক্ষেও অত্যাবশ্যক—তাহা বল, তাহা বীর্য। য়ুরোপ যে কর্মের দ্বারা যে অবস্থার মধ্যে আত্মাকে উপলব্ধি করিতেছে আমরা সে কর্মের দ্বারা সে অবস্থার মধ্যে আত্মাকে উপলব্ধি করিব না—আমাদের সম্মুখে অন্য পথ, আমাদের চতুর্দিকে অন্যরূপ পরিবেশ, আমাদের অতীতের ইতিহাস অন্যরূপ, আমাদের শক্তির মূলসঞ্চয় অন্যত্র—কিন্তু আমাদের সেই বীর্য আবশ্যক যাহা থাকিলে পথকে ব্যবহার করিতে পারিব, পরিবেশকে অনুকূল করিতে পারিব, অতীতের ইতিহাসকে বর্তমানে সফল করিতে পারিব এবং শক্তির গূঢ় সঞ্চয়কে আবিষ্কৃত উদ্ঘাটিত করিয়া তাহার অধিকারী হইতে পারিব। ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’—আত্মা তো আছেই, কিন্তু বল নাই বলিয়া তাহাকে লাভ করিতে পারি না। ত্যাগ করিতে শক্তি নাই, দুঃখ পাইতে সাহস নাই, লক্ষ্য অনুসরণ করিতে নিষ্ঠা নাই; কৃশ সংকল্পের দৌর্বল্য, ক্ষীণ শক্তির আত্মবঞ্চনা, সুখবিলাসের ভীরুতা, লোকলজ্জা, লোকভয় আমাদিগকে মুহূর্তে মুহূর্তে যথার্থভাবে আত্মপরিচয় আত্মলাভ আত্মপ্রতিষ্ঠা হইতে দূরে রাখিতেছে। সেইজন্যই ভিক্ষুকের মতো আমরা অপরের মাহাত্ম্যের প্রতি ঈর্ষা করিতেছি এবং মনে করিতেছি, বাহ্য অবস্থা যদি দৈবক্রমে অন্যের মতো হয় তবেই আমাদের সকল অভাব, সকল লজ্জা দূর হইতে পারে।
বিদেশের ইতিহাস যদি আমরা ভালো করিয়া পড়িয়া দেখি তবে দেখিতে পাইব, মহত্ত্ব কত বিচিত্র প্রকারের—গ্রীসের মহত্ত্ব এবং রোমের মহত্ত্ব একজাতীয় নহে—গ্রীস বিদ্যা ও বিজ্ঞানে বড়ো, রোম কর্মে ও বিধিতে বড়ো। রোম তাহার বিজয়পতাকা লইয়া