কাদম্বরীচিত্র

কাদম্বরীর যে প্রসঙ্গটি চিত্রে বিবৃত হইয়াছে সেইটি সংস্কৃত হইতে বাংলায় ব্যাখ্যা করিলেই ইহার উপযুক্ত ভূমিকা হয়। সেই প্রসঙ্গটি কাদম্বরীর ঠিক প্রবেশদ্বারেই। আলোচনা করিতে করিতে ঠিক সেই পর্যন্তই আসিয়াছিলাম, কিন্তু লোভে পড়িয়া নানা দিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, পুনর্বার সেইখানে ফেরা যাক।—

নবপ্রভাতে রাজা শূদ্রক সভাতলে বসিয়া আছেন এমন সময় প্রতিহারী আসিয়া ক্ষিতিতলনিহিতজানুকরকমলা হইয়া নিবেদন করিল, ‘দক্ষিণাপথ হইতে চণ্ডালকন্যা একটি পিঞ্জরস্থ শুক লইয়া কহিতেছে যে, মহারাজ সমুদ্রের ন্যায় সকল ভুবনতলের সর্বরত্নের একমাত্র ভাজন, এই বিহঙ্গটিও একটি পরমাশ্চর্য রত্নবিশেষ বলিয়া দেবপাদমূলে প্রদান করিবার জন্য আমি আগত হইয়াছি, অতএব দেবদর্শনসুখ অনুভব করিতে ইচ্ছা করি। '

পাঠকগণ মনে করিবেন না প্রতিহারী এত সংক্ষেপে নিষ্কৃতি পাইয়াছে; অকৃপণা কবিপ্রতিভা তাহার প্রতিও অজস্র কল্পনাবর্ষণ করিয়াছে—তাহার বামপার্শ্বে অঙ্গনাজনবিরুদ্ধ কিরীচাস্ত্র লম্বিত থাকাতে তাহাকে বিষধরজড়িত চন্দনলতার মতো ভীষণরমণীয় দেখিতে হইয়াছে, সে শরৎলক্ষ্মীর ন্যায় কলহংসশুভ্রবসনা এবং বিন্ধ্যবনভূমির ন্যায় বেত্রলতাবতী; সে যেন মূর্তিমতী রাজাজ্ঞা, যেন বিগ্রহিণী রাজ্যাধিদেবতা।

সমীপবর্তী রাজগণের মুখাবলোকন করিয়া উপজাতকুতূহল রাজা প্রতিহারীকে কহিলেন, তাহাকে প্রবেশ করিতে দাও। প্রতিহারী তখন চণ্ডালকন্যাকে সভাস্থলে উপস্থিত করিল।

সেখানে অশনিভয়পুঞ্জিত-শৈলশ্রেণীমধ্যগত কনকশিখরী মেরুর ন্যায় নরপতিসহস্রমধ্যবর্তী রাজা। নানা রত্নাভরণকিরণজালে তাঁহার অবয়ব প্রচ্ছন্নপ্রায় হওয়াতে মনে হইতেছে যেন সহস্র ইন্দ্রায়ুধে অষ্টদিগ্জ‌বিভাগ আচ্ছাদিত করিয়া বর্ষাকালের ঘনগম্ভীর দিন বিরাজমান। লম্বিতস্থূলমুক্তাকলাপ ও স্বর্ণশৃঙ্খলে-বদ্ধ মণিদণ্ডচতুষ্টয়ে অমল শুভ্র অনতিবৃহৎ দুকূলবিতান বিস্তৃত, তাহারই অধোভাগে ইন্দুকান্তমণিপর্যঙ্কে রাজা নিষণ্ন; তাঁহার পার্শ্বে কনকদণ্ড চামরকলাপ উদ্ধূয়মান্‌; পরাভবপ্রণত শশীর ন্যায় বিশদোজ্জ্বল স্ফটিকপাদপীঠে তাঁহার বামপদ বিন্যস্ত; অমৃতফেনের ন্যায় তাঁহার লঘুশুভ্র দুকূলবসনের প্রান্তে গোরোচনার দ্বারা হংসমিথুনমালা অঙ্কিত; অতি সুগন্ধ চন্দনানুলেপনে তাঁহার উরঃস্থল ধবলিত, তাহারই মধ্যে মধ্যে কুসুমচর্চিত হওয়াতে স্থানে স্থানে নিপতিত প্রভাতরবিকিরণে অঙ্কিত কৈলাসশিখরীর ন্যায় তিনি শোভমান; ইন্দ্রনীল অঙ্গদযুগলে তিনি দুই বাহুতে চপলা রাজলক্ষ্মীকে যেন বাঁধিয়া রাখিয়াছেন; তাঁহার কর্ণোৎপল ঈষৎ আলম্বিত, মস্তকে আমোদিত মালতীমালা, যেন উষাকালে অস্তা চলশিখরে তারকাপুঞ্জ পর্যন্ত। সেবাসংগতা অঙ্গনাগণ দিগ্‌বধূর ন্যায় তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া আছে। তখন প্রতিহারী নরপতিকে প্রবুদ্ধ করিবার জন্য রক্তকুবলয়দলকোমল হস্তে বেণুলতা গ্রহণ করিয়া একবার সভাকুট্টিমে আঘাত করিল। তৎক্ষণাৎ তালফলপেতনশব্দে বনকরীযূথের ন্যায় রাজগণ মুখ আবলিত করিয়া তদভিমুখে দৃষ্টিপাত করিলেন।

তাঁহারা দেখিলেন, আর্যবেশধারী ধবলবসন একটি বৃদ্ধ চণ্ডাল অগ্রে আসিতেছে, তাহার পশ্চাতে কাকপক্ষধারী একটি বালক স্বর্ণশলাকানির্মিত পিঞ্জরে বিহঙ্গকে বহন করিয়া আনিতেছে। এবং তাহার পশ্চাতে নিদ্রার ন্যায় লোচনগ্রাহিণী এবং মূর্ছার ন্যায় মনোহরা একটি তরুণযৌবনা কন্যা-অসুরগৃহীত অমৃত অপহরণের জন্য কপ্‌টপটুবিলাসিনীবেশধারী ভগবান হরির ন্যায় সে শ্যামবর্ণা, যেন একটি সঞ্চারিণী ইন্দ্রনীলমণিপুত্তলিকা; আগুল্‌ফবিলম্বিত নীলকঞ্চুকের দ্বারা তাহার শরীর আচ্ছন্ন এবং তাহারই উপরে রক্তাংশুকের অবগুণ্ঠনে যেন নীলোৎপলবনে সন্ধ্যালোক পড়িয়াছে; একটি কর্ণের উপরে উদয়োন্মুখ-ইন্দু-কিরণচ্ছটার ন্যায় একটি শুভ্র কেতকীপত্র আসক্ত; ললাটে রক্তচন্দনের তিলক, যেন কিরাতবেশা ত্রিলোচনা ভবানী।

আমাদের সমালোচ্য চিত্রের বিষয়টি কিঞ্চিৎ সংক্ষেপে অনুবাদ করিয়া দিলাম। সংস্কৃত কবিদের মধ্যে চিত্রাঙ্কনে বাণভট্টের সমতুল্য কেহ নাই, এ কথা আমরা সাহস করিয়া বলিতে পারি। সমস্ত কাদম্বরী কাব্য একটি চিত্রশালা। সাধারণত লোকে ঘটনা বর্ণনা