আত্মপরিচয় ১

তোমার আনন্দ রবে তারি মাঝখানে।

মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া,

প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া।

আমি বালকবয়সে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ' লিখিয়াছিলাম — তখন আমি নিজে ভালো করিয়া বুঝিয়াছিলাম কি না জানি না — কিন্তু তাহাতে এই কথা ছিল যে, এই বিশ্বকে গ্রহণ করিয়া, এই সংসারকে বিশ্বাস করিয়া, এই প্রত্যক্ষকে শ্রদ্ধা করিয়া আমরা যথার্থভাবে অনন্তকে উপলব্ধি করিতে পারি। যে জাহাজে অনন্তকোটি লোক যাত্রা করিয়া বাহির হইয়াছে তাহা হইতে লাফ দিয়া পড়িয়া সাঁতারের জোরে সমুদ্র পার হইবার চেষ্টা সফল হইবার নহে।

হে বিশ্ব, হে মহাতরী, চলেছ কোথায়?

আমারে তুলিয়া লও তোমার আশ্রয়ে।

একা আমি সাঁতারিয়া পারিব না যেতে।

কোটি কোটি যাত্রী ওই যেতেছে চলিয়া —

আমিও চলিতে চাই উহাদেরি সাথে।

যে পথে তপন শশী আলো ধরে আছে

সে পথ করিয়া তুচ্ছ, সে আলো ত্যজিয়া

আপনারি ক্ষুদ্র এই খদ্যোত-আলোকে

কেন অন্ধকারে মরি পথ খুঁজে খুঁজে।

পাখি যবে উড়ে যায় আকাশের পানে

মনে করে এনু বুঝি পৃথিবী ত্যজিয়া ;

যত ওড়ে, যত ওড়ে, যত ঊর্ধ্বে যায়,

কিছুতে পৃথিবী তবু পারে না ছাড়িতে —

অবশেষে শ্রান্তদেহে নীড়ে ফিরে আসে।

পরিণত বয়সে যখন ‘মালিনী' নাট্য লিখিয়াছিলাম, তখনো এইরূপ দূর হইতে নিকটে, অনির্দিষ্ট হইতে নির্দিষ্টে, কল্পনা হইতে প্রত্যক্ষের মধ্যেই ধর্মকে উপলব্ধি করিবার কথা বলিয়াছি —

বুঝিলাম ধর্ম দেয় স্নেহ মাতারূপে,

পুত্ররূপে স্নেহ লয় পুন ; দাতারূপে

করে দান, দীনরূপে করে তা গ্রহণ ;

শিষ্যরূপে করে ভক্তি, গুরুরূপে করে

আশীর্বাদ ; প্রিয়া হয়ে পাষাণ-অন্তরে

প্রেম-উৎস লয় টানি, অনুরক্ত হয়ে

করে সর্বত্যাগ। ধর্ম বিশ্বলোকালয়ে

ফেলিয়াছে চিত্তজাল, নিখিল ভুবন

টানিতেছে প্রেমক্রোড়ে — সে মহাবন্ধন