নৌকাডুবি
ঠাণ্ডা ঘাসের উপর বসিয়া পড়িল, কাঠের মূর্তির মতো স্থির হইয়া রহিল; তাহার চোখ দিয়া এক ফোঁটা জল বাহির হইল না।

এমন কতক্ষণ সে বসিয়া থাকিত বলা যায় না; কিন্তু তীব্র শীত তাহার হৃৎপিণ্ডকে দোলাইয়া দিল, তাহার সমস্ত শরীর ঠক্‌ ঠক্‌ করিয়া কাঁপিতে লাগিল। গভীর রাত্রে কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রোদয় যখন নিস্তব্ধ তালবনের অন্তরালে অন্ধকারের একটি প্রান্তকে ছিন্ন করিয়া দিল তখন কমলা ধীরে ধীরে উঠিয়া ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল।

সকালবেলা কমলা চোখ মেলিয়া দেখিল, শৈল তাহার খাটের পাশে দাঁড়াইয়া আছে। অনেক বেলা হইয়া গেছে বুঝিয়া লজ্জিত কমলা তাড়াতাড়ি বিছানার উপর উঠিয়া বসিল।

শৈল কহিল, “না ভাই, তুমি উঠিয়ো না, আর একটু ঘুমাও— নিশ্চয় তোমার শরীর ভালো নাই। তোমার মুখ বড়ো শুকনো দেখাইতেছে, চোখের নীচে কালি পড়িয়া গেছে। কী হইয়াছে ভাই, আমাকে বলো-না।” বলিয়া শৈলজা কমলার পাশে বসিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল।

কমলার বুক ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, তাহার অশ্রু আর বাধা মানে না। শৈলজার কাঁধের উপর মুখ লুকাইয়া তাহার কান্না একেবারে ফাটিয়া বাহির হইল। শৈল একটি কথাও না বলিয়া তাহাকে দৃঢ় করিয়া আলিঙ্গন করিয়া ধরিল।

একটু পরেই কমলা তাড়াতাড়ি শৈলজার বাহুবন্ধন ছাড়াইয়া উঠিয়া পড়িল, চোখ মুছিয়া ফেলিয়া জোর করিয়া হাসিতে লাগিল। শৈল কহিল, “নাও নাও, আর হাসিতে হইবে না। ঢের ঢের মেয়ে দেখিয়াছি, তোমার মতো এমন চাপা মেয়ে আমি দেখি নাই। কিন্তু তুমি মনে করিতেছ আমার কাছে লুকাইবে— আমাকে তেমন হাবা পাও নাই। তবে বলিব? রমেশবাবু এলাহাবাদে গিয়া অবধি তোমাকে একখানি চিঠি লেখেন নি তাই রাগ হইয়াছে— অভিমানিনী! কিন্তু তোমারও বোঝা উচিত, তিনি সেখানে কাজে গেছেন, দু দিন বাদেই আসিবেন, ইহার মধ্যে যদি সময় করিয়া উঠিতে না পারেন তাই বলিয়া কি অত রাগ করিতে আছে। ছি! তাও বলি ভাই, তোমাকে আজ এত উপদেশ দিতেছি, আমি হইলেও ঠিক ঐ কাণ্ডটি করিয়া বসিতাম। এমন মিছিমিছি কান্না মেয়েমানুষকে অনেক কাঁদিতে হয়। আবার এই কান্না ঘুচিয়া গিয়া যখন হাসি ফুটিয়া উঠিবে তখন কিছুই মনে থাকিবে না।” এই বলিয়া কমলাকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া শৈল কহিল, “আজ তুমি মনে করিতেছ, রমেশবাবুকে আর কখনো তুমি মাপ করিবে না— তাই না? আচ্ছা, সত্যি বলো।”

কমলা কহিল, “হাঁ, সত্যিই বলিতেছি।”

শৈল কমলার গালে করতলের আঘাত করিয়া কহিল, “ইস! তাই বৈকি! দেখা যাইবে। আচ্ছা বাজি রাখো।”

কমলার সঙ্গে কথাবার্তা হইবার পরেই শৈল এলাহাবাদে তাহার বাপকে চিঠি পাঠাইল। তাহাতে লিখিল, “কমলা রমেশবাবুর কোনো চিঠিপত্র না পাইয়া অত্যন্ত চিন্তিত আছে। একে বেচারা নূতন বিদেশে আসিয়াছে, তাহার ’পরে রমেশবাবু যখন-তখন তাহাকে ফেলিয়া চলিয়া যাইতেছেন এবং চিঠিপত্র লিখিতেছেন না, ইহাতে তাহার কী কষ্ট হইতেছে একবার ভাবিয়া দেখো দেখি। তাঁহার এলাহাবাদের কাজ কি আর শেষ হইবে না নাকি? কাজ তো ঢের লোকের থাকে, কিন্তু তাই বলিয়া দুই ছত্র চিঠি লিখিবার কি অবসব পাওয়া যায় না?”

খুড়া রমেশের সঙ্গে দেখা করিয়া তাঁহার কন্যার পত্রের অংশবিশেষ শুনাইয়া ভর্ৎসনা করিলেন। কমলার দিকে রমেশের মন যথেষ্ট পরিমাণে আকৃষ্ট হইয়াছে এ কথা সত্য, কিন্তু আকৃষ্ট হইয়াছে বলিয়াই তাহার দ্বিধা আরো বাড়িয়া উঠিল।

এই দ্বিধার মধ্যে পড়িয়া রমেশ কোনোমতেই এলাহাবাদ হইতে ফিরিতে পারিতেছিল না। ইতিমধ্যে খুড়ার কাছ হইতে শৈলর চিঠি শুনিল।

চিঠি হইতে বেশ বুঝিতে পারিল, কমলা রমেশের জন্য বিশেষ উদ্‌‍বেগ প্রকাশ করিতেছে— সে কেবল নিজে লজ্জায় লিখিতে