প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
বঙ্গদেশের কীর্তনে কাব্য ও সংগীতের সম্মিলন এক আশ্চর্য আকার ধারণ করিয়াছে; তাহাতে কাব্যও পরিপূর্ণ এবং সংগীতও প্রবল। মনে হয় যেন ভাবের-বোঝাই-পূর্ণ সোনার কবিতা, ভরা সুরের সংগীত-নদীর মাঝখান দিয়া বেগে ভাসিয়া চলিয়াছে। সংগীত কেবল-যে কবিতাটিকে বহন করিতেছে তাহা নহে তাহার নিজেরও একটা ঐশ্বর্য এবং ঔদার্য এবং মর্যাদা প্রবলভাবে প্রকাশ পাইতেছে।
আমাদের সমালোচ্য গ্রন্থখানিতে উভয় শ্রেণীরই গান দেখা যায়। ইহার মধ্যে কতকগুলি গান আছে যাহা সুখপাঠ্য নহে, যাহার ছন্দ ও ভাববিন্যাস সুরতালের অপেক্ষা রাখে, সেগুলি সাহিত্যসমালোচকের অধিকারবহির্ভূত। আর-কতকগুলি গান আছে যাহা কাব্য হিসাবে অনেকটা সম্পূর্ণ–যাহা পাঠমাত্রেই হৃদয়ে ভাবের উদ্রেক ও সৌন্দর্যের সঞ্চার করে। যদিচ সে-গানগুলির মাধুর্যও সম্ভবত সুরসংযোগে অধিকতর পরিস্ফুটতা, গভীরতা এবং নূতনত্ব লাভ করিতে পারে তথাপি ভালো এনগ্রেভিং হইতে তাহার আদর্শ অয়েলপেন্টিঙের সৌন্দর্য যেমন অনেকটা অনুমান করিয়া লওয়া যায় তেমনি কেবলমাত্র সেই-সকল কবিতা হইলে গানের সমগ্র মাধুর্য আমরা মনে মনে পূরণ করিয়া লইতে পারি। উদাহরণস্বরূপ ‘একবার দেখে যাও দেখে যাও কত দুখে যাপি দিবানিশি’ কীর্তনটির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি। ইহা বেদনায় পরিপূর্ণ, অনুরাগে অনুনয়ে পরিপ্লুত। পাঠ করিতে করিতে সঙ্গে সঙ্গে ইহার আকুতিপূর্ণ সংগীতটি আমাদের কল্পনায় ধ্বনিত হইতে থাকে। সম্ভবত যে সুরে এই গান বাঁধা হইতেছে তাহা আমাদের কল্পনার আদর্শের সহিত তুলনীয় হইতে পারে না। না হইবারই কথা। কারণ, এই কবিতাটি কিঞ্চিৎ বৃহৎ এবং বিচিত্র; এবং আমাদের সংগীত সাধারণত একটিমাত্র সংক্ষিপ্ত স্থায়ী ভাব অবলম্বন করিয়া আত্মপ্রকাশ করে; ভাব হইতে ভাবান্তরে বিচিত্র আকারে ও নব নব ভঙ্গিতে অভিব্যক্ত হইয়া উঠে না। এইজন্য আমাদের বক্ষ্যমাণ কবিতাটির উপযুক্ত রাগিণী আমরা সহজে প্রত্যাশা করিতে পারি না। কিন্তু কোনো সুর না থাকিলেও ইহাকে আমরা গান বলিব–কারণ, ইহাতে আমাদের মনের মধ্যে গানের একটা আকাঙক্ষা রাখিয়া দেয়–যেমন ছবিতে একটা নির্ঝরিণী আঁকা দেখিলে তাহার গতিটি আমরা মনের ভিতর হইতে পূরণ করিয়া লই। গান এবং কবিতার প্রভেদ আমরা এই গ্রন্থ হইতেই তুলনার দ্বারা দেখাইয়া দিতে পারি।
সে কে? – এ জগতে কেহ আছে, অতি উচ্চ মোর কাছে
যার প্রতি তুচ্ছ অভিলাষ ;
সে কে? – অধীন হইয়ে, তবু রহে যে আমার প্রভু ;
প্রভু হয়ে আমি যার দাস ;
সে কে? – দূর হতে দূরাত্মীয়, প্রিয়তম হতে প্রিয়,
আপন হইতে যে আপন ;
সে কে? – লতা হতে ক্ষীণ তারে বাঁধে দৃঢ় যে আমারে,
ছাড়াতে পারি না আজীবন ;
সে কে? – দুর্বলতা যার বল, মর্মভেদী অশ্রুজল ;
প্রেম - উচ্চারিত রোষ যার ;
সে কে? – যার পরিতোষ মম সফল জনমসম ;
সুখ - সিদ্ধি সব সাধনার ;
সে কে? – হলেও কঠিন চিত শিশুসম স্নেহভীত
যার কাছে পড়ি গিয়া নুয়ে ;