পরিশিষ্ট

প্রতিবাদ-লেখক মহাশয় হাস্যরসের অবতারণা করিয়া লিখিয়াছেন :

যদি কেহ লেখেন, ‘যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বলিলেন–প্রিয়ে, তুমি যে-কথা বলিতেছ তাহার বিস্‌মোল্লায়ই গলদ’ তাহা হইলে প্রয়োগটি কি অতিশোভন হইবে।

প্রয়োগের শোভনতাবিচার ব্যাকরণের কাজ নহে, অলংকারশাস্ত্রের কাজ–ইহা পণ্ডিতমহাশয় জানেন না, এ কথা বিশ্বাস করিতে আমাদের সাহস হয় না। উল্লিখিত প্রয়োগে ব্যাকরণের কোনো ভুলই নাই, অলংকারের দোষ আছে। ‘বিস্‌মোল্লায় গলদ’ কথাটা এমন জায়গাতেও বসিতে পারে যেখানে অলংকারের দোষ না হইয়া গুণ হইবে। অতএব পণ্ডিতমশায়ের রসিকতা এখানে বাজে খরচ হইল। যাঁহারা প্রাকৃত বাংলার ব্যাকরণ লিখিতেছেন, তাঁহার এই হাস্যবাণে বাসায় গিয়া মরিয়া থাকিবেন না। শ্রীযুক্ত পণ্ডিতমহাশয় এ কথাও মনে রাখিবেন যে, চলিত ভাষা অস্থানে বসাইলেই যে কেবল ভাষার প্রয়োগদোষ হয়, তাহা নহে; বিশুদ্ধ সংস্কৃতশব্দ বিশুদ্ধ সংস্কৃতনিয়মে বাংলায় বসাইলেও অলংকারদোষ ঘটিতে পারে। কেহ যদি বলেন, আপনার সুন্দরী বক্তৃতা শুনিয়া অদ্যকার সভা আপ্যায়িতা হইয়াছে, তবে তাহাতে স্বর্গীয় বোপদেবের কোনো আপত্তি থাকিবার কথা নাই, কিন্তু শ্রোতারা গাম্ভীর্য রক্ষা না করিতেও পারেন।

খাঁটি বাংলাকথাগুলির নিয়ম অত্যন্ত পাকা–উট কথাটাকে কোনোমতেই স্ত্রীলিঙ্গে ‘উটী’ করা যাইবে না, অথবা দাগ শব্দের উত্তর কোনোমতেই ইত প্রত্যয় করিয়া ‘দাগিত’ হইবে না, ইহাতে সংস্কৃত ব্যাকরণ যতই চক্ষু রক্তবর্ণ করুন। কিন্তু সংস্কৃতশব্দের বেলায় আমাদের স্বাধীনতা অনেকটা বেশি। আমরা ইচ্ছা করিলে ‘এই মেয়েটি বড়ো সুন্দরী’ বলিতে পারি, আবার ‘এই মেয়েটি বড়ো সুন্দর’ ইহাও বলা চলে। আমাদের পণ্ডিতমশায় এক জায়গায় লিখিয়াছেন, ‘বিদ্যা যশের হেতুরূপে প্রতীয়মান হয়।’ প্রতীয়মান কথাটা তিনি বাংলা ব্যাকরণের নিয়মে ব্যবহার করিয়াছেন, কিন্তু যদি সংস্কৃতনিয়মে ‘প্রতীয়মানা’ লিখিতেন তাহাও চলিত। আর এক জায়গায় লিখিয়াছেন, ‘বিভীষিকাময়ী ছায়াটাকে বঙ্গভাষার অধিকার হইতে নিষ্কাশিত করিয়া দিতে পারেন’–ছায়া শব্দের এক বিশেষণ ‘বিভীষিকাময়ী’ সংস্কৃত বিধানে হইল, অন্য বিশেষণ ‘নিষ্কাশিত’ বাংলানিয়মেই হইল। ইহা হইতে দেখা যাইতেছে, সংস্কৃতশব্দ বাংলাভাষায় সুবিধামত কখনো নিজের নিয়মে চলে, কখনো বাংলানিয়মে চলে। কিন্তু খাঁটি বাংলাকথার সে-স্বাধীনতা নাই–’কথাটা উপযুক্তা হইয়াছে’ এমন প্রয়োগ চলিতেও পারে, কিন্তু ‘কথাটা ঠিক হইয়াছে’ না বলিয়া যদি ‘ঠিকা হইয়াছে’ বলি, তবে তাহা সহ্য করা অন্যায় হইবে। অতএব বাংলারচনায় সংস্কৃতশব্দ কোথায় বাংলানিয়মে, কোথায় সংস্কৃতনিয়মে চলিবে তাহা ব্যাকরণকার বাঁধিয়া দিবেন না, তাহা অলংকারশাস্ত্রের আলোচ্য। কিন্তু বাংলাশব্দ ভাষার ভূষণ নহে, ভাষার অঙ্গ–সুতরাং তাহাকে বোপদেবের সূত্রে মোচড় দিলে চলিবে না, তাহাতে সমস্ত ভাষার গায়ে ব্যথা লাগিবে; এইজন্যই, ‘ভ্রাতৃবধূ একাকী আছেন’ অথবা ‘একাকিনী আছেন’ দু-ই বলিতে পারি–কিন্তু ‘আমার ভাজ একলা আছেন’ না বলিয়া ‘এক্‌লানী আছেন’ এমন প্রয়োগ প্রাণান্ত সংকটে পড়িলেও করা যায় না। অতএব, বাংলাভাষায় সস্কৃতশব্দ কিরূপ নিয়মে ব্যবহার করা যাইবে, তাহা লইয়া পণ্ডিতে পণ্ডিতে যত ইচ্ছা লড়াই করুন, বাংলা-বৈয়াকরণের সে-যুদ্ধে রক্তপাত করিবার অবকাশ নাই।

আমার প্রবন্ধে আমি ইংরেজি monosyllabic অর্থে ‘একমাত্রিক’ কথা ব্যবহার করিয়াছিলাম, এবং ‘দেখ্‌, মার্‌’ প্রভৃতি ধাতুকে একমাত্রিক বলিয়াছিলাম, ইহাতে প্রতিবাদী মহাশয় অত্যন্ত রাগ করিয়াছেন। তিনি বলেন :

ব্যাকরণশাস্ত্রানুসারে হ্রস্বস্বরের একমাত্রা, দীর্ঘস্বরের দুইমাত্রা, প্লুতস্বরের তিনমাত্রা ও ব্যঞ্জনবর্ণের অর্ধমাত্রা গণনা করা হয়।

অতএব তাঁহার মতে দেখ্‌ ধাতু আড়াইমাত্রিক। এই যুক্তি অনুসারে ‘একমাত্রিক’ শব্দটাকে তিনি বিদেশী বলিয়া গণ্য করেন।

ইহাকেই বলে বিস্ে‌মোল্লায় গলদ। মাত্রা ইংরেজিই কী বাংলাই কী আর সংস্কৃতই কী। যদিচ প্রাচীন ভারতবর্ষ আধুনিক ভারতের চেয়ে অনেক বিষয়ে অনেক বড়ো ছিল, তবু ‘এক’ তখনো ‘এক’ই ছিল এবং দুই ছিল ‘দুই’। পণ্ডিতমশায় যদি যথেষ্ট