বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত

পূর্বে দেখানো গিয়াছে, একমাত্রিক ধাতুর উত্তর আ প্রত্যয় করিয়া ক্রিয়াবাচক দুই-অক্ষরের বিশেষ্য বিশেষণ সিদ্ধ হয়; যেমন, ধরা মারা ইত্যাদি।

বহুমাত্রিকে আ প্রত্যয় না হইয়া আন্‌ ও তদুত্তরে অ প্রত্যয় হয়; যেমন, চুল্‌কান (উচ্চারণ চুলকানো) কাম্‌ড়ান (কামড়ানো) ছটফটান (ছটফটানো) ইত্যাদি।

কিন্তু সাধারণত নৈমিত্তিক ক্রিয়াপদকেই ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য বিশেষণে পরিণত করিতে আন্‌ + অ প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়; যেমন করা শব্দ হইতে নৈমিত্তিক অর্থে করান, বলা হইতে বলান।

ইহাই সাধারণ নিয়ম, কিন্তু কয়েকটি ব্যতিক্রমও দেখা যায়; যেমন পড়া হইতে নৈমিত্তিক পাড়া, চলা হইতে চালা, গলা হইতে গালা, নড়া হইতে নাড়া, জ্বলা হইতে জ্বালা, মরা হইতে মারা, বহা হইতে বাহা, জরা হইতে জারা।

কিন্তু পড়া হইতে পড়ান, নড়া হইতে নড়ান, চলা হইতে চলান, ইহাও হয়। এমন কি, নৈমিত্তিক ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যপদ চালা নাড়া পাড়া প্রভৃতির উত্তর পুনশ্চ আন্‌+অ যোগ করিয়া চালান পাড়ান নাড়ান হইয়া থাকে।

কিন্তু তাকান গড়ান (বিছানায়) আঁচান প্রভৃতি অনৈমিত্তিক শব্দ সম্বন্ধে কী বুঝিতে হইবে। তাকা গড়া আঁচা, হইল না কেন।

তাহার কারণ, এইগুলির মূল ধাতু একমাত্রিক নহে। দেখ্‌, একমাত্রিক ধাতু, তাহা হইতে ‘দেখা’ হইয়াছে; কিন্তু তাকান শব্দের মূল ধাতুটি তাক্‌ নহে, তাহা তাকা, সেইজন্যই উক্তধাতুকে বিশেষ্য করিতে আন্‌+অ প্রত্যয়ের প্রয়োজন হইয়াছে। নামধাতুগুলিও আন্‌+অ প্রত্যয়ের অপেক্ষা রাখে; যেমন, লাথ্‌ হইতে লাথান, পিঠ্‌ হইতে পিঠান (পিটোনো), হাত হইতে হাতান।

মূল ধাতু বহুমাত্রিক কি না, তাহার পরীক্ষার অন্য উপায় আছে। অনুজ্ঞায় আমরা দেখ্‌ ধাতুর উত্তর ‘ও’ প্রত্যয় করিয়া বলি, দেখো, কিন্তু তাকো বলি না; তাকা ধাতুর উত্তর ও প্রত্যয় করিয়া বলি তাকাও। গঠন করো, বলিতে হইলে গড়্‌ ধাতুর উত্তর ও প্রত্যয় করিয়া বলি গড়ো, কিন্তু, শয়ন করো, বুঝাইতে হইলে গড়া ধাতুর উত্তর ও প্রত্যয় করিয়া বলি গড়াও।

আমাদের বহুমাত্রিক ক্রিয়াবাচক শব্দগুলি আকারান্ত, সেইজন্য পুনশ্চ তাহার উত্তর আ প্রত্যয় না হইয়া আন্‌+অ প্রত্যয় হয়। মূল শব্দটি আট্‌কা বা চম্‌কা না হইলে অনুজ্ঞায় আট্‌কাও হইত না, চম্‌কাও হইত না। হিন্দিতে পাকড়্‌ শব্দের উত্তর ও প্রত্যয় হইয়া পাকড়ো হয়; সেই শব্দই বাংলায় পাক্‌ড়া রূপ ধরিয়া পাকড়াও হইয়া দাঁড়ায়।

অন্‌ প্রত্যয়

দৃষ্টান্ত : মাতন্‌ চলন্‌ কাঁদন্‌ গড়ন্‌ (গঠনক্রিয়া) ইত্যাদি। ইহারা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য শব্দ। অন্‌ প্রত্যয়সিদ্ধ পদার্থবাচক শব্দের উদাহরণও মনে পড়ে; যেমন, ঝাড়ন্‌ বেলুন্‌ (রুটি বেলিবার) মাজন্‌ গড়ন্‌ (শরীরের) ফোড়ন্‌ ঝোঁটন্‌ (ঝুঁটি হইতে) পাঁচন্‌।

অন +আ প্রত্যয়

অন্‌ প্রত্যয়ের উত্তর পুনশ্চ আ প্রত্যয় করিয়া কতকগুলি ক্রিয়াবাচক বিশেষণের সৃষ্টি হইয়াছে; ইহারা বিকল্পে বিশেষ্যও হয়; যেমন, পাওন্‌ হইতে পাওনা, দেওন্‌ হইতে দেনা, ফেলন্‌ হইতে ফেল্‌না, মাগন্‌ হইতে মাগ্‌না, শুকন্‌ হইতে শুক্‌না।

পদার্থবাচক বিশেষ্যেরও দৃষ্টান্ত আছে; যেমন, বাট্‌না কুট্‌না ওড়্‌না ঝরনা খেলনা বিছানা বাজ্‌না ঢাক্‌না।

ই প্রত্যয়

ধর্ম ও ব্যবসায় অর্থে : গোলাপি বেগুনি চালাকি চাকরি চুক্তিডাক্তারি মোক্তারি ব্যারিস্টারি মাস্টারি; খাড়াই (খাড়া পদার্থের ধর্ম) লম্বাই চৌড়াই ঠাণ্ডাই আড়ি (আড় অর্থাৎ বক্র হইবার ভাব)।

অনুকরণ অর্থে : সাহেবি নবাবি।

দক্ষ অর্থে : হিসাবদক্ষ হিসাবি, আলাপদক্ষ আলাপি, ধ্রুপদদক্ষ ধ্রুপদি।