প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
যোগেন্দ্র। দেখো অক্ষয়, তোমার ঐ-সকল প্যাঁচালো চাল আমার ভালো লাগে না। বেশ বুঝিতেছি একটা কী খবর তোমার বলিবার আছে, সেটাকে আড়াল করিয়া অমন দর-বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিতেছ কেন? সরলভাবে বলিয়া ফেলো, চুকিয়া যাক।
অক্ষয়। আচ্ছা বেশ, তাহা হইলে গোড়া হইতেই বলি— তুমি অনেক কথাই জান না।
রমেশ দরজিপাড়ায় যে বাসায় ছিল, সে বাসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হইয়া যায় নাই, তাহা আর-কাহাকেও ভাড়া দেওয়া সম্বন্ধে রমেশ চিন্তা করিবার অবসর পায় নাই। সে এই কয়েক মাস সংসারের বাহিরে উধাও হইয়া গিয়াছিল, লাভক্ষতিকে বিচারের মধ্যেই আনে নাই।
আজ সে প্রত্যুষে সেই বাসায় গিয়া ঘর-দুয়ার সাফ করাইয়া লইয়াছে, তক্তপোশের উপর বিছানা পাতাইয়াছে এবং আহারাদিরও বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছে। আজ ইস্কুলে ছুটির পর কমলাকে আনিতে হইবে।
সে এখনো দেরি আছে। ইতিমধ্যে রমেশ তক্তপোশের উপর চিত হইয়া ভবিষ্যতের কথা ভাবিতে লাগিল। এটোয়া সে কখনো দেখে নাই— কিন্তু পশ্চিমের দৃশ্য কল্পনা করা কঠিন নহে। শহরের প্রান্তে তাহার বাড়ি-তরুশ্রেণীদ্বারা ছায়াখচিত বড়ো রাস্তা তাহার বাগানের ধার দিয়া চলিয়া গেছে— রাস্তার ও পারে প্রকাণ্ড মাঠ, তাহার মাঝে মাঝে কূপ, মাঝে মাঝে পশুপক্ষী তাড়াইবার জন্য মাচা বাঁধা। ক্ষেত্রসেচনের জন্য গোরু দিয়া জল তোলা হইতেছে, সমস্ত মধ্যাহ্নে তাহার করুণ শব্দ শোনা যায়— রাস্তা দিয়া প্রচুর ধুলা উড়াইয়া মাঝে মাঝে এক্কাগাড়ি ছুটিয়াছে, তাহার ঝন্ ঝন্ শব্দে রৌদ্রদগ্ধ আকাশ জাগিয়া উঠিতেছে। এই সুদূর প্রবাসের প্রখর তাপ, উদাস মধ্যাহ্ন ও শূন্য নির্জনতার মধ্যে সে তাহার রুদ্ধদ্বার বাংলাঘরে সমস্ত দিন হেমনলিনীকে একা কল্পনা করিতে গেলে ক্লেশ অনুভব করিত। তাহার পাশে চিরসখীরূপে কমলাকে দেখিয়া সে আরামবোধ করিল।
রমেশ ঠিক করিয়াছে, এখন সে কমলাকে কিছু বলিবে না। বিবাহের পর হেমনলিনী তাহাকে বুকের উপর টানিয়া লইয়া সুযোগ বুঝিয়া সকরুণ স্নেহের সহিত ক্রমে ক্রমে তাহাকে তাহার প্রকৃত ইতিহাস জানাইবে, যত অল্প বেদনা দিয়া সম্ভব কমলার জীবনের এই জটিল রহস্যজাল ধীরে ধীরে ছাড়াইয়া দিবে। তাহার পরে সেই দূর বিদেশে তাহাদের পরিচিত সমাজের বাহিরে, কোনোপ্রকার আঘাত না পাইয়া কমলা অতি সহজেই তাহাদের সঙ্গে মিশিয়া আপনার হইয়া যাইবে।
তখন দ্বিপ্রহরে গলি নিস্তব্ধ; যাহারা আপিসে যাইবার, তাহারা আপিসে গেছে, যাহারা না যাইবার, তাহারা দিবানিদ্রার আয়োজন করিতেছে। অনতিতপ্ত আশ্বিনের মধ্যাহ্নটি মধুর হইয়া উঠিয়াছে— আগামী ছুটির উল্লাস এখনি যেন আকাশকে আনন্দের আভাস দিয়া মাখাইয়া রাখিয়াছে। রমেশ তাহার নির্জন বাসায় নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে সুখের ছবি উত্তরোত্তর ফলাও করিয়া আঁকিতে লাগিল।
এমন সময়ে খুব একটা ভারী গাড়ির শব্দ শোনা গেল। সে গাড়ি রমেশের বাসার দ্বারের কাছে আসিয়া থামিল। রমেশ বুঝিল, ইস্কুলের গাড়ি কমলাকে পৌঁছাইয়া দিতে আসিতেছে। তাহার বুকের ভিতরটা চঞ্চল হইয়া উঠিল। কমলাকে কিরূপ দেখিবে, তাহার সঙ্গে কী ভাবে কথাবার্তা হইবে, কমলাই বা রমেশকে কী ভাবে গ্রহণ করিবে, হঠাৎ এই চিন্তা তাহাকে আন্দোলিত করিয়া তুলিল।
নীচে তাহার দুই জন চাকর ছিল— প্রথমে তাহারা ধরাধরি করিয়া কমলার তোরঙ্গ লইয়া আসিয়া বারান্দায় রাখিল—