প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
পরদিন সকালের গাড়িতে যোগেন্দ্র পশ্চিম হইতে ফিরিয়া আসিল। আজ শনিবার, কাল রবিবারে হেমনলিনীর বিবাহের কথা। কিন্তু যোগেন্দ্র তাহাদের বাসার দ্বারের কাছে আসিয়া উৎসবের স্বাদগন্ধ কিছুই পাইল না। যোগেন্দ্র মনে করিয়া আসিতেছিল এতক্ষণে তাহাদের বাসার বারান্দার উপর দেবদারুপাতার মালা ঝোলানো শুরু হইয়াছে— কাছে আসিয়া দেখিল, শ্রীহীন মালিন্যে পাশের বাড়ির সঙ্গে তাহাদের বাড়ির কোনো প্রভেদ নাই।
ভয় হইল পাছে কাহারো অসুখ-বিসুখ করিয়া থাকে। বাড়িতে প্রবেশ করিয়া দেখিল চায়ের টেবিলে তাহার জন্য আহারাদি প্রস্তুত রহিয়াছে এবং অন্নদাবাবু অর্ধভুক্ত চায়ের পেয়ালা সম্মুখে রাখিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছেন।
যোগেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, “হেম কেমন আছে?”
অন্নদা। ভালো।
যোগেন্দ্র। বিবাহের কী হইল?
অন্নদা। কাল রবিবারের পরের রবিবারে হইবে।
যোগেন্দ্র। কেন?
অন্নদা। কেন, তাহা তোমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করো। রমেশ আমাদের কেবল এইটুকু জানাইয়াছে যে, তাহার বিশেষ প্রয়োজন আছে, এ রবিবারে বিবাহ বন্ধ রাখিতে হইবে।
যোগেন্দ্র তাহার অক্ষম বাপের উপরে মনে মনে বিরক্ত হইয়া কহিল, “বাবা, আমি না থাকিলে তোমাদের নানান গলদ ঘটে। রমেশের আবার প্রয়োজন কিসের? সে স্বাধীন। তাহার আত্মীয় বলিতে কেহ নাই বলিলেই হয়। যদি তাহার বৈষয়িক বিশেষ কোনো গোলযোগ ঘটিয়া থাকে, সে কথা খুলিয়া বলিবার কোনো বাধা দেখি না। রমেশকে তুমি এত সহজে ছাড়িয়া দিলে কেন?”
অন্নদা। আচ্ছা, বেশ তো, সে তো এখনো পালায় নাই— তুমিই তাহাকে প্রশ্ন করিয়া দেখো-না।
যোগেন্দ্র শুনিয়া তৎক্ষণাৎ এক পেয়ালা গরম চা তাড়াতাড়ি নিঃশেষ করিয়া বাহির হইয়া গেল।
অন্নদাবাবু কহিলেন, “আহা যোগেন, এত তাড়াতাড়ি কিসের? তোমার যে খাওয়া হইল না।”
সে কথা যোগেন্দ্রের কানে পৌঁছিল না। সে রমেশের বাসায় ঢুকিয়া সশব্দ দ্রুতপদে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া গেল।— “রমেশ! রমেশ!”— রমেশের কোনো সাড়া নাই। ঘরে ঘরে খুঁজিয়া দেখিল— রমেশ শুইবার ঘরে নাই, বসিবার ঘরে নাই, ছাদে নাই, একতলায় নাই। অনেক ডাকাডাকির পর বেহারাটাকে সন্ধান করিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাবু কোথায়?”
বেহারা কহিল, “বাবু তো ভোরে বাহির হইয়া গেছেন।”
যোগেন্দ্র। কখন আসিবে?
বেহারা জানাইল— বাবু তাঁহার কতক-কতক কাপড়-চোপড় লইয়া চলিয়া গেছেন। বলিয়া গেছেন ফিরিয়া আসিতে তাঁহার চার-পাঁচ দিন দেরি হইতে পারে। কোথায় গেছেন তাহা বেহারা জানে না।
যোগেন্দ্র গম্ভীর হইয়া চায়ের টেবিলে ফিরিয়া আসিল। অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হইল?”
যোগেন্দ্র বিরক্ত হইয়া কহিল, “হইবে আর কী, যাহার সঙ্গে আজ বাদে কাল মেয়ের বিবাহ দিবে তাহার কী কাজ পড়িয়াছে, সে কখন কোথায় থাকে, তাহার খোঁজখবর তোমরা কিছুই রাখ না। অথচ তোমার বাড়ির পাশেই তাহার বাসা।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “কেন, কাল রাত্রেও তো রমেশ ঐ বাসাতেই ছিল।”