নৌকাডুবি
গিয়াছিলাম।”

শুনিয়াই রমেশের মুখে উদ্‌‍বেগের ছায়া পড়িল।

অক্ষয় হাসিয়া কহিল, “ভয় কিসের রমেশবাবু? আপনাকে আক্রমণ করিতে যাই নাই। শুভসংবাদে অভিনন্দন প্রকাশ করা বন্ধুবান্ধবের কর্তব্য— তাহাই পালন করিতে গিয়াছিলাম।”

এই কথায় অন্নদাবাবুর মনে পড়িল হেমনলিনী উপস্থিত নাই। হেমনলিনীকে ডাক দিলেন— উত্তর না পাইয়া তিনি নিজে উপরে গিয়া কহিলেন, “হেম, এ কী, এখনো সেলাই লইয়া বসিয়া আছ! চা তৈরি যে। রমেশ-অক্ষয় আসিয়াছে।”

হেমনলিনী মুখ ঈষৎ লাল করিয়া কহিল, “বাবা, আমার চা উপরে পাঠাইয়া দাও, আজ আমি সেলাইটা শেষ করিতে চাই।”

অন্নদা। ঐ তোমার দোষ হেম! যখন যেটা লইয়া পড়, তখন আর-কিছুই খেয়াল কর না। যখন পড়া লইয়া ছিলে তখন বই কোল হইতে নামিত না— এখন সেলাই লইয়া পড়িয়াছ, এখন আর-সমস্তই বন্ধ। না না, সে হইবে না— চলো, নীচে গিয়া চা খাইবে চলো।

এই বলিয়া অন্নদাবাবু জোর করিয়াই হেমনলিনীকে নীচে লইয়া আসিলেন। সে আসিয়াই কাহারো দিকে দৃষ্টি না করিয়া তাড়াতাড়ি চা ঢালিবার ব্যাপারে ভারি ব্যস্ত হইয়া উঠিল।

অন্নদাবাবু অধীর হইয়া কহিলেন, “হেম, ও কী করিতেছ? আমার পেয়ালায় চিনি দিতেছ কেন? আমি তো কোনোকালেই চিনি দিয়া চা খাই না।”

অক্ষয় টিপিটিপি হাসিয়া কহিল, “আজ উনি ঔদার্য সংবরণ করিতে পারিতেছেন না— আজ সকলকেই মিষ্ট বিতরণ করিবেন।”

হেমনলিনীর প্রতি এই প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ রমেশের মনে মনে অসহ্য হইল। সে তৎক্ষণাৎ স্থির করিল, আর যাই হউক, বিবাহের পরে অক্ষয়ের সহিত কোনো সম্পর্ক রাখা হইবে না।

অক্ষয় কহিল, “রমেশবাবু, আপনার নামটা বদলাইয়া ফেলুন।”

রমেশ এই রসিকতার চেষ্টায় অধিকতর বিরক্ত হইয়া কহিল, “কেন বলুন দেখি।”

অক্ষয় খবরের কাগজ খুলিয়া কহিল, “এই দেখুন, আপনার নামের একজন ছাত্র অন্য লোককে নিজের নামে চালাইয়া পরীক্ষা দেওয়াইয়া পাস হইয়াছিল— হঠাৎ ধরা পড়িয়াছে।”

হেমনলিনী জানে, রমেশ মুখের উপর উত্তর দিতে পারে না— সেইজন্য এতকাল অক্ষয় রমেশকে যত আঘাত করিয়াছে সে-ই তাহার প্রতিঘাত দিয়া আসিয়াছে। আজও থাকিতে পারিল না। গূঢ় ক্রোধের লক্ষণ চাপিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিল, “অক্ষয় বলিয়া ঢের লোক বোধ হয় জেলখানায় আছে।”

অক্ষয় কহিল, “ঐ দেখুন, বন্ধুভাবে সৎপরামর্শ দিতে গেলে আপনারা রাগ করেন। তবে সমস্ত ইতিহাসটা বলি। আপনি তো জানেন, আমার ছোটো বোন শরৎ বালিকা-বিদ্যালয়ে পড়িতে যায়। সে কাল সন্ধ্যার সময় আসিয়া কহিল, ‘দাদা, তোমাদের রমেশবাবুর স্ত্রী আমাদের ইস্কুলে পড়েন।’ আমি বলিলাম, ‘দূর পাগলী! আমাদের রমেশবাবু ছাড়া কি আর দ্বিতীয় রমেশবাবু জগতে নাই?’ শরৎ কহিল, ‘তা যেই হোন, তিনি তাঁর স্ত্রীর উপরে ভারি অন্যায় করিতেছেন। ছুটিতে প্রায় সব মেয়েই বাড়ি যাইতেছে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে বোর্ডিঙে রাখিবার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। সে বেচারা কাঁদিয়া কাটিয়া অনর্থপাত করিতেছে।’ আমি তখনি মনে মনে কহিলাম, এ তো ভালো কথা নহে, শরৎ যেমন ভুল করিয়াছিল, এমন ভুল আরো তো কেহ কেহ করিতে পারে!”

অন্নদাবাবু হাসিয়া উঠিয়া কহিলেন, “অক্ষয়, তুমি কী পাগলের মতো কথা কহিতেছ! কোন্‌ রমেশের স্ত্রী ইস্কুলে পড়িয়া