নৌকাডুবি
ভালোবাসা কাঙাল!


১৪

রমেশ অন্নদাবাবুর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। তখন অন্নদাবাবু মুখের উপরে খবরের কাগজ চাপা দিয়া কেদারায় পড়িয়া নিদ্রা দিতেছিলেন। রমেশ ঘরে প্রবেশ করিয়া কাশিতেই তিনি চকিত হইয়া উঠিয়া খবরের কাগজটা তুলিয়া ধরিয়াই কহিলেন, “দেখিয়াছ রমেশ, এবারে ওলাউঠায় কত লোক মরিয়াছে?”

রমেশ কহিল, “বিবাহ এখন কিছুদিন বন্ধ রাখিতে হইবে— আমার বিশেষ কাজ আছে।”

অন্নদাবাবুর মাথা হইতে শহরের মৃত্যুতালিকার বিবরণ একেবারে লুপ্ত হইয়া গেল। ক্ষণকাল রমেশের মুখের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “সে কী কথা রমেশ! নিমন্ত্রণ যে হইয়া গেছে।”

রমেশ কহিল, “এই রবিবারের পরের রবিবারে দিন পিছাইয়া দিয়া আজই পত্র বিলি করিয়া দেওয়া যাইতে পারে।”

অন্নদা। রমেশ, তুমি আমাকে অবাক করিলে। একি মকদ্দমা যে, তোমার সুবিধামত তুমি দিন পিছাইয়া মুলতুবি করিতে থাকিবে? তোমার প্রয়োজনটা কী, শুনি।

রমেশ। সে অত্যন্ত বিশেষ প্রয়োজন, বিলম্ব করিলে চলিবে না।

অন্নদাবাবু বাতাহত কদলীবৃক্ষের মতো কেদারার উপর হেলান দিয়া পড়িলেন— কহিলেন, “বিলম্ব করিলে চলিবে না! বেশ কথা, অতি উত্তম কথা! এখন তোমার যাহা ইচ্ছা হয় করো। নিমন্ত্রণ ফিরাইয়া লইবার ব্যবস্থা তোমার বুদ্ধিতে যাহা আসে, তাহাই হোক। লোকে যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করিবে আমি বলিব, ‘আমি ও-সব কিছুই জানি না— তাঁহার কী আবশ্যক সে তিনিই জানেন, আর কবে তাঁহার সুবিধা হইবে সে তিনিই বলিতে পারেন।”

রমেশ উত্তর না করিয়া নতমুখে বসিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেমনলিনীকে সব কথা বলা হইয়াছে?”

রমেশ। না, তিনি এখনো জানেন না।

অন্নদা। তাঁহার তো জানা আবশ্যক। তোমার তো একলার বিবাহ নয়।

রমেশ। আপনাকে আগে জানাইয়া তাঁহাকে জানাইব স্থির করিয়াছি।

অন্নদাবাবু ডাকিয়া উঠিলেন, “হেম! হেম!”

হেমনলিনী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কহিল, “কী বাবা?”

অন্নদা। রমেশ বলিতেছেন, উঁহার কী-একটা বিশেষ কাজ পড়িয়াছে, এখন উঁহার বিবাহ করিবার অবকাশ হইবে না।

হেমনলিনী একবার বিবর্ণমুখে রমেশের মুখের দিকে চাহিল। রমেশ অপরাধীর মতো নিরুত্তরে বসিয়া রহিল।

হেমনলিনীর কাছে এ খবরটা যে এমন করিয়া দেওয়া হইবে, রমেশ তাহা প্রত্যাশা করে নাই। অপ্রিয় বার্তা অকস্মাৎ এইরূপ নিতান্ত রূঢ়ভাবে হেমনলিনীকে যে কিরূপ মর্মান্তিকরূপে আঘাত করিল, রমেশ তাহা নিজের ব্যথিত অন্তঃকরণের মধ্যেই সম্পূর্ণ অনুভব করিতে পারিল। কিন্তু যে তীর একবার নিক্ষিপ্ত হয়, তাহা আর ফেরে না— রমেশ যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল এই নিষ্ঠুর তীর হেমনলিনীর হৃদয়ের ঠিক মাঝখানে গিয়া বিঁধিয়া রহিল।

এখন কথাটা আর কোনোমতে নরম করিয়া লইবার উপায় নাই। সবই সত্য— বিবাহ এখন স্থগিত রাখিতে হইবে, রমেশের বিশেষ প্রয়োজন আছে, কী প্রয়োজন তাহাও সে বলিতে ইচ্ছা করে না। ইহার উপরে এখন আর নূতন ব্যাখ্যা কী হইতে পারে?