চার অধ্যায়
পারি একটা কোন্‌ পায়ের শব্দের প্রত্যাশায় তোমার কান পাতা থাকে। গেল শুক্রবারে যখন এলুম তোমার ঘরে, তুমি ভেবেছিলে আর-কেউ বা। দেখলুম মনটা ঠিক করে নিতে কিছু সময় লাগল। লজ্জা করো না তুমি, এতে অসংগত কিছুই নেই।”

কর্ণমূল লাল করে চুপ করে রইল এলা।

ইন্দ্রনাথ বললে, “তুমি একজনকে ভালোবেসেছ, এই তো? তোমার মন তো জড় পাষাণে গড়া নয়। যাকে ভালোবাস তাকেও জানি। অনুশোচনার কারণ কিছুই দেখছি নে।”

“আপনি বলেছিলেন একমনা হয়ে কাজ করতে হবে। সকল অবস্থায় তা সম্ভব না হতে পারে।”

“সকলের পক্ষে নয়। কিন্তু ভালোবাসার গুরুভারে তোমার ব্রত ডোবাতে পারে তুমি তেমন মেয়ে নও।”

“কিন্তু—”

“এর মধ্যে কিন্তু কিছুই নেই—তুমি কিছুতেই নিষ্কৃতি পাবে না।”

“আমি তো আপনাদের কোনো কাজে লাগি নে, সে আপনি জানেন।”

“তোমার কাছ থেকে কাজ চাই নে, কাজের কথা সব জানাইও নে তোমাকে। কেমন করে তুমি নিজে বুঝবে তোমার হাতের রক্তচন্দনের ফোঁটা ছেলেদের মনে কী আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেটুকু বাদ দিয়ে কেবল শুখো মাইনেয় কাজ করতে গেলে পুরো কাজ পাব না। আমরা কামিনীকাঞ্চনত্যাগী নই। যেখানে কাঞ্চনের প্রভাব সেখানে কাঞ্চনকে অবজ্ঞা করি নে, যেখানে কামিনীর প্রভাব সেখানে কামিনীকে বেদীতে বসিয়েছি।”

“আপনার কাছে মিথ্যে বলব না, বুঝতে পারছি আমার ভালোবাসা দিনে দিনেই আমার অন্য সকল ভালোবাসাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”

“কোনো ভয় নেই, খুব ভালোবাসো। শুধু মা মা স্বরে দেশকে যারা ডাকাডাকি করে, তারা চিরশিশু। দেশ বৃদ্ধ শিশুদের মা নয়, দেশ অর্ধনারীশ্বর— মেয়ে-পুরুষের মিলনে তার উপলব্ধি। এই মিলনকে নিস্তেজ করো না সংসার-পিঁজরেয় বেঁধে।”

“কিন্তু তবে আপনি যে ওই উমা—”

“উমা! কালু!— ভালোবাসার শুষ্ক রুদ্ররূপ ওরা সইতে পারবে কী করে? যে দাম্পত্যের ঘাটে ওদের সকল সাধনার অন্ত্যেষ্টিসৎকার, সময় থাকতে সেখানেই দুজনকে গঙ্গাযাত্রায় পাঠাচ্ছি — সেকথা থাক্‌। শোনা গেল তোমার ঘরে ডাকাত ঢুকেছিল পরশু রাত্রে।”

“হা, ঢুকেছিল।”

“তোমার জুজুৎসু শিক্ষায় ফল পেয়েছিলে কি?”

“আমার বিশ্বাস ডাকাতের কবজি দিয়েছি ভেঙে।”

“মনটার ভিতর আহা উহু করে ওঠে নি?”

“করত কিন্তু ভয় ছিল ও আমাকে অপমান করবে। ও যদি যন্ত্রণায় হার মানত আমি শেষ পর্যন্ত মোচড় দিতে পারতুম না।”

“চিনতে পেরেছিলে সে কে?”

“অন্ধকারে দেখতে পাই নি।”

“যদি পেতে তাহলে জানতে, সে অনাদি।”

“আহা সে কী কথা। আমাদের অনাদি! সে যে ছেলেমানুষ।”

“আমিই তাকে পাঠিয়েছিলুম।” “আপনিই! কেন এমন কাজ করলেন?”