প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
হরিমোহিনী বলিয়া উঠিলেন, “আমি তো তোমাদের ভাব কিছুই বুঝে উঠতে পারি নে। তোমারই তো ছেলে ওঁকে হিন্দুমতে লইয়েছেন, তুমি হঠাৎ আকাশ থেকে পড়লে চলবে কেন?”
পরেশবাবুর বাড়িতে সর্বদাই অপরাধভীরুর মতো যে হরিমোহিনী ছিলেন, যিনি কোনো মানুষকে ঈষৎমাত্র অনুকূল বোধ করিলেই একান্ত আগ্রহের সহিত অবলম্বন করিয়া ধরিতেন, সে হরিমোহিনী কোথায়? নিজের অধিকার রক্ষা করিবার জন্য ইনি আজ বাঘিনীর মতো দাঁড়াইয়াছেন; তাঁহার সুচরিতাকে তাঁহার কাছ হইতে ভাঙাইয়া লইবার জন্য চারি দিকে নানা বিরুদ্ধ শক্তি কাজ করিতেছে এই সন্দেহে তিনি সর্বদাই কণ্টকিত হইয়া আছেন। কে স্বপক্ষ কে বিপক্ষ তাহা বুঝিতেই পারিতেছেন না, এইজন্য তাঁহার মনে আজ আর স্বচ্ছন্দতা নাই। পূর্বে সমস্ত সংসারকে শূন্য দেখিয়া যে দেবতাকে ব্যাকুলচিত্তে আশ্রয় করিয়াছিলেন সেই দেবপূজাতেও তাঁহার চিত্ত স্থির হইতেছে না। একদিন তিনি ঘোরতর সংসারী ছিলেন— নিদারুণ শোকে যখন তাঁহার বিষয়ে বৈরাগ্য জন্মিয়াছিল তখন তিনি মনেও করিতে পারেন নাই যে আবার কোনোদিন তাঁহার টাকাকড়ি ঘরবাড়ি আত্মীয়পরিজনের প্রতি কিছুমাত্র আসক্তি ফিরিয়া আসিবে; কিন্তু আজ হৃদয়ক্ষতের একটু আরোগ্য হইতেই সংসার পুনরায় তাঁহার সম্মুখে আসিয়া তাঁহার মনকে টানাটানি করিতে আরম্ভ করিয়াছে, আবার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা তাহার অনেক দিনের ক্ষুধা লইয়া পূর্বের মতোই জাগিয়া উঠিতেছে, যাহা ত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলেন সেই দিকে পুনর্বার ফিরিবার বেগ এমনি উগ্র হইয়া উঠিয়াছে যে, সংসারে যখন ছিলেন তখনো তাঁহাকে এত চঞ্চল করিতে পারে নাই। অল্প কয় দিনেই হরিমোহিনীর মুখে চক্ষে, ভাবে ভঙ্গিতে, কথায় ব্যবহারে এই অভাবনীয় পরিবর্তনের লক্ষণ দেখিয়া আনন্দময়ী একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন এবং সুচরিতার জন্য তাঁহার স্নেহকোমল হৃদয়ে অত্যন্ত ব্যথা বোধ করিতে লাগিলেন। এমন যে একটা সংকট প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে তাহা জানিলে তিনি কখনোই সুচরিতাকে ডাকিতে আসিতেন না। এখন কী করিলে সুচরিতাকে আঘাত হইতে বাঁচাইতে পারিবেন সে তাহার পক্ষে একটা সমস্যার বিষয় হইয়া উঠিল।
গোরার প্রতি লক্ষ করিয়া যখন হরিমোহিনী কথা কহিলেন তখন সুচরিতা মুখ নত করিয়া নীরবে ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল।
আনন্দময়ী কহিলেন, “তোমার ভয় নেই বোন! আমি তো আগে জানতুম না। তা, আর ওকে পীড়াপীড়ি করব না। তুমিও ওকে আর কিছু বোলো না। ও আগে একরকম করে মানুষ হয়েছে, হঠাৎ ওকে যদি বেশি চাপ দাও সে আবার সইবে না।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “সে কি আমি বুঝি নে, আমার এত বয়স হল! তোমার মুখের সামনেই বলুক-না, আমি কি ওকে কোনোদিন কিছু কষ্ট দিয়েছি। ওর যা খুশি তাই তো করছে, আমি কখনো একটি কথা কই নে— বলি, ভগবান ওকে বাঁচিয়ে রাখুন সেই আমার ঢের— যে আমার কপাল, কোন্দিন কী ঘটে সেই ভয়ে ঘুম হয় না।”
আনন্দময়ী যাইবার সময় সুচরিতা তাহার ঘর হইতে বাহির হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। আনন্দময়ী সকরুণ স্নেহে তাহাকে স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমি আসব, মা, তোমাকে সব খবর দিয়ে যাব— কোনো বিঘ্ন হবে না— ঈশ্বরের আশীর্বাদে শুভকর্ম সম্পন্ন হয়ে যাবে।”
সুচরিতা কোনো কথা কহিল না।
পরদিন প্রাতে আনন্দময়ী লছমিয়াকে লইয়া যখন সেই বাসাবাড়ির বহুদিনসঞ্চিত ধূলি ক্ষয় করিবার জন্য একেবারে জলপ্লাবন বাধাইয়া দিয়াছেন, এমন সময় সুচরিতা আসিয়া উপস্থিত হইল। আনন্দময়ী তাড়াতাড়ি ঝাঁটা ফেলিয়া দিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইলেন।
তার পরে ধোওয়ামোছা জিনিসপত্র-নাড়াচাড়া ও সাজানোর ধুম পড়িয়া গেল। পরেশবাবু খরচের জন্য সুচরিতার হাতে উপযুক্ত পরিমাণ টাকা দিয়াছিলেন; সেই তহবিল লইয়া উভয়ে মিলিয়া বার বার করিয়া কত ফর্দ তৈরি এবং তাহার সংশোধনে প্রবৃত্ত