গোরা
হইলেন।

অনতিকাল পরে পরেশ স্বয়ং ললিতাকে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। ললিতার পক্ষে তাহার বাড়ি অসহ্য হইয়াছিল। কেহ তাহাকে কোনো কথা বলিতে সাহস করিত না, কিন্তু তাহাদের নীরবতা পদে পদে তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল। অবশেষে বরদাসুন্দরীর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করিবার জন্য যখন তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণ দলে দলে বাড়িতে আসিতে লাগিল তখন পরেশ ললিতাকে এ বাড়ি হইতে লইয়া যাওয়াই শ্রেয় জ্ঞান করিলেন। ললিতা বিদায় হইবার সময় বরদাসুন্দরীকে প্রণাম করিতে গেল; তিনি মুখ ফিরাইয়া বসিয়া রহিলেন এবং সে চলিয়া গেলে অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। ললিতার বিবাহ-ব্যাপারে লাবণ্য ও লীলার মনে মনে যথেষ্ট ঔৎসুক্য ছিল; কোনো উপায়ে যদি তাহারা ছুটি পাইত তবে বিবাহ-আসরে ছুটিয়া যাইতে এক মুহূর্ত বিলম্ব করিত না। কিন্তু ললিতা যখন বিদায় হইয়া গেল তখন ব্রাহ্মপরিবারের কঠোর কর্তব্য স্মরণ করিয়া তাহারা মুখ অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া রহিল। দরজার কাছে সুধীরের সঙ্গে চকিতের মতো ললিতার দেখা হইল; কিন্তু সুধীরের পশ্চাতেই তাহাদের সমাজের আরো কয়েক জন প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন, এই কারণে তাহার সঙ্গে কোনো কথা হইতেই পারিল না। গাড়িতে উঠিয়া ললিতা দেখিল আসনের এক কোণে কাগজে মোড়া কী-একটা রহিয়াছে। খুলিয়া দেখিল, জর্মান-রৌপ্যের একটি ফুলদানি, তাহার গায়ে ইংরাজি ভাষায় খোদা রহিয়াছে, ‘আনন্দিত দম্পতিকে ঈশ্বর আশীর্বাদ করুন’ এবং একটি কার্ডে ইংরাজিতে সুধীরের কেবল নামের আদ্যক্ষরটি ছিল। ললিতা আজ হৃদয়কে কঠিন করিয়া পণ করিয়াছিল সে চোখের জল ফেলিবে না, কিন্তু পিতৃগৃহ হইতে বিদায়-মুহূর্তে তাহাদের বাল্যবন্ধুর এই একটিমাত্র স্নেহোপহার হাতে লইয়া তাহার দুই চক্ষু দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। পরেশবাবু চক্ষু মুদ্রিত করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন।

আনন্দময়ী “এসো এসো, মা এসো” বলিয়া ললিতার দুই হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরে লইয়া আসিলেন, যেন এখনই তাহার জন্য তিনি প্রতীক্ষা করিয়া ছিলেন।

পরেশবাবু সুচরিতাকে ডাকাইয়া আনিয়া কহিলেন, “ললিতা আমার ঘর থেকে একেবারে বিদায় নিয়ে এসেছে।”

পরেশের কণ্ঠস্বর কম্পিত হইয়া গেল।

সুচরিতা পরেশের হাত ধরিয়া কহিল, “এখানে ওর স্নেহযত্নের কোনো অভাব হবে না বাবা!”

পরেশ যখন চলিয়া যাইতে উদ্যত হইয়াছেন এমন সময়ে আনন্দময়ী মাথার উপর কাপড় টানিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিয়া তাঁহাকে নমস্কার করিলেন। পরেশ ব্যস্ত হইয়া তাঁহাকে প্রতিনমস্কার করিলেন। আনন্দময়ী কহিলেন, “ললিতার জন্যে আপনি কোনো চিন্তা মনে রাখবেন না। আপনি যার হাতে ওকে সমর্পণ করছেন তার দ্বারা ও কখনো কোনো দুঃখ পাবে না— আর ভগবান এতকাল পরে আমার এই একটি অভাব দূর করে দিলেন, আমার মেয়ে ছিল না, আমি মেয়ে পেলুম। বিনয়ের বউটিকে নিয়ে আমার কন্যার দুঃখ ঘুচবে অনেক দিন ধরে এই আশাপথ চেয়ে বসে ছিলুম; তা অনেক দেরিতে যেমন ঈশ্বর আমার কামনা পূরণ করে দিলেন, তেমনি এমন মেয়ে দিলেন আর এমন আশ্চর্য রকম করে দিলেন যে, আমি আমার এমন ভাগ্য কখনো মনে চিন্তাও করতে পারতুম না।”

ললিতার বিবাহের আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার পর হইতে এই প্রথম পরেশবাবুর চিত্ত সংসারের মধ্যে এক জায়গায় একটা কূল দেখিতে পাইল এবং যথার্থ সান্ত্বনা লাভ করিল।