প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
“কর্তব্যকর্ম তো সকলেরই আছে। আপনি যে সকল ছাড়িয়া কালেজের বাসায় যান, সে কি কাহারো অপরাধে। আমারও যাইতে হইবে না? আমারও কর্তব্য নাই?”
মহেন্দ্র ভালো উত্তর অনেক ভাবিয়া খুঁজিয়া পাইল না। কিছুক্ষণ থামিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার এমন কী কর্তব্য যে না গেলেই নয়।”
বিনোদিনী অত্যন্ত সাবধানে সূচিতে সুতা পরাইতে পরাইতে কহিল, “কর্তব্য আছে কি না, সে নিজের মনই জানে। আপনার কাছে তাহার আর কী তালিকা দিব।”
মহেন্দ্র গম্ভীর চিন্তিত মুখে জানালার বাহিরে একটা সুদূর নারিকেলগাছের মাথার দিকে চাহিয়া অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বিনোদিনী নিঃশব্দে সেলাই করিয়া যাইতে লাগিল। ঘরে ছুঁচটি পড়িলে শব্দ শোনা যায়, এমনি হইল। অনেকক্ষণ পরে মহেন্দ্র হঠাৎ কথা কহিল। অকসমাৎ নিঃশব্দতাভঙ্গে বিনোদিনী চমকিয়া উঠিল– তাহার হাতে ছুঁচ ফুটিয়া গেল।
মহেন্দ্র কহিল, “তোমাকে কোনো অনুনয়-বিনয়েই রাখা যাইবে না?”
বিনোদিনী তাহার আহত অঙ্গুলি হইতে রক্তবিন্দু শুষিয়া লইয়া কহিল, “কিসের জন্য এত অনুনয়-বিনয়। আমি থাকিলেই কী, আর না থাকিলেই কী। আপনার তাহাতে কী আসে যায়।”
বলিতে বলিতে গলাটা যেন ভারি হইয়া আসিল; বিনোদিনী অত্যন্ত মাথা নিচু করিয়া সেলাইয়ের প্রতি একান্ত মনোনিবেশ করিল– মনে হইল, হয়তো বা তাহার নতনেত্রের পল্লবপ্রান্তে একটুখানি জলের রেখা দেখা দিয়াছে। মাঘের অপরাহ্ন তখন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলাইবার উপক্রম করিতেছিল।
মহেন্দ্র মুহূর্তের মধ্যে বিনোদিনীর হাত চাপিয়া ধরিয়া রুদ্ধ সজলস্বরে কহিল, “যদি তাহাতে আমার আসে যায়, তবে তুমি থাকিবে?”
বিনোদিনী তাড়াতাড়ি হাত ছাড়াইয়া লইয়া সরিয়া বসিল। মহেন্দ্রের চমক ভাঙিয়া গেল। নিজের শেষ কথাটা ভীষণ ব্যঙ্গের মতো তাহার নিজের কানে বারংবার প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। অপরাধী জিহ্বাকে মহেন্দ্র দন্ত দ্বারা দংশন করিল– তাহার পর হইতে রসনা নির্বাক হইয়া রহিল।
এমন সময় এই নৈঃশব্দ্যপরিপূর্ণ ঘরের মধ্যে আশা প্রবেশ করিল। বিনোদিনী তৎক্ষণাৎ যেন পূর্ব-কথোপকথনের অনুবৃত্তিস্বরূপে হাসিয়া মহেন্দ্রকে বলিয়া উঠিল, “আমার গুমর তোমরা যখন এত বাড়াইলে, তখন আমারও কর্তব্য, তোমাদের একটা কথা রাখা। যতক্ষণ না বিদায় দিবে ততক্ষণ রহিলাম।”
আশা স্বামীর কৃতকার্যতায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া সখীকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল। কহিল, “তবে এই কথা রহিল। তাহা হইলে তিন-সত্য করো, যতক্ষণ না বিদায় দিব ততক্ষণ থাকিবে, থাকিবে, থাকিবে।”
বিনোদিনী তিনবার স্বীকার করিল। আশা কহিল, “ভাই চোখের বালি, সেই যদি রহিলেই তবে এত করিয়া সাধাইলে কেন। শেষকালে আমার স্বামীর কাছে তো হার মানিতে হইল।”
বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “ঠাকুরপো, আমি হার মানিয়াছি, না তোমাকে হার মানাইয়াছি?”
মহেন্দ্র এতক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া ছিল; মনে হইতেছিল, তাহার অপরাধে যেন সমস্ত ঘর ভরিয়া রহিয়াছে, লাঞ্ছনা যেন তাহার সর্বাঙ্গ পরিবেষ্টন করিয়া। আশার সঙ্গে কেমন করিয়া সে প্রসন্নমুখে স্বাভাবিকভাবে কথা কহিবে। এক মুহূর্তের মধ্যে কেমন করিয়া সে আপনার বীভৎস অসংযমকে সহাস্য চটুলতায় পরিণত করিবে। এই পৈশাচিক ইন্দ্রজাল তাহার আয়ত্তের বহির্ভূত ছিল। সে গম্ভীরমুখে কহিল, “আমারই তো হার হইয়াছে।” বলিয়াই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।