প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
মহেন্দ্র ভাবিল, ‘এ তো বড়ো অদ্ভুত। আমি ভাবিয়াছিলাম, এবার বিনোদিনীকে বিশেষ করিয়াই দেখা যাইবে– উলটা হইল? তবে সে চিঠিগুলার অর্থ কী।’
নারীহৃদয়ের রহস্য বুঝিবার কোনো চেষ্টা করিবে না বলিয়াই মহেন্দ্র মনকে দৃঢ় করিয়াছিল– ভাবিয়াছিল, ‘বিনোদিনী যদি কাছে আসিবার চেষ্টা করে, তবু আমি দূরে থাকিব।’ আজ সে মনে মনে কহিল, “না, এ তো ঠিক হইতেছে না। যেন আমাদের মধ্যে সত্যই কী একটা বিকার ঘটিয়াছে। বিনোদিনীর সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা আমোদপ্রমোদ করিয়া এই সংশয়াচ্ছন্ন গুমটের ভাবটা দূর করিয়া দেওয়া উচিত।’
আশাকে মহেন্দ্র কহিল, “দেখিতেছি, আমিই তোমার সখীর চোখের বালি হইলাম। আজকাল তাঁহার আর দেখাই পাওয়া যায় না।”
আশা উদাসীন ভাবে উত্তর করিল, “কে জানে, তাহার কী হইয়াছে।”
এ দিকে রাজলক্ষ্মী আসিয়া কাঁদো-কাঁদো হইয়া কহিলেন, “বিপিনের বউকে আর তো ধরিয়া রাখা যায় না।”
মহেন্দ্র চকিত ভাব সামলাইয়া কহিল, “কেন, মা।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কি জানি বাছা, সে তো এবার বাড়ি যাইবার জন্য নিতান্তই ধরিয়া পড়িয়াছে। তুই তো কাহাকেও খাতির করিতে জানিস না। ভদ্রলোকের মেয়ে পরের বাড়িতে আছে, উহাকে আপনার লোকের মতো আদর-যত্ন না করিলে থাকিবে কেন।”
বিনোদিনী শোবার ঘরে বসিয়া বিছানার চাদর সেলাই করিতেছিল। মহেন্দ্র প্রবেশ করিয়া ডাকিল, “বালি।”
বিনোদিনী সংযত হইয়া বসিল। কহিল, “কী, মহেন্দ্রবাবু।”
মহেন্দ্র কহিল, “কী সর্বনাশ। মহেন্দ্র আবার বাবু হইলেন কবে।”
বিনোদিনী আবার চাদর সেলাইয়ের দিকে নতচক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া কহিল, “তবে কী বলিয়া ডাকিব।”
মহেন্দ্র কহিল, “তোমার সখীকে যা বল– চোখের বালি।”
বিনোদিনী অন্যদিনের মতো ঠাট্টা করিয়া তাহার কোনো উত্তর দিল না– সেলাই করিয়া যাইতে লাগিল।
মহেন্দ্র কহিল, “ওটা বুঝি সত্যকার সম্বন্ধ হইল, তাই ওটা আর পাতানো চলিতেছে না!”
বিনোদিনী একটু থামিয়া দাঁত দিয়া সেলাইয়ের প্রান্ত হইতে খানিকটা বাড়তি সুতা কাটিয়া ফেলিয়া কহিল, “কী জানি, সে আপনি জানেন।”
বলিয়াই তাহার সর্বপ্রকার উত্তর চাপা দিয়া গম্ভীরমুখে কহিল, “কালেজ হইতে হঠাৎ ফেরা হইল যে?”
মহেন্দ্র কহিল, “কেবল মড়া কাটিয়া আর কত দিন চলিবে।”
আবার বিনোদিনী দন্ত দিয়া সুতা ছেদন করিল এবং মুখ না তুলিয়াই কহিল, “এখন বুঝি জিয়ন্তের আবশ্যক।”
মহেন্দ্র স্থির করিয়াছিল, আজ বিনোদিনীর সঙ্গে অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ভাবে হাস্যপরিহাস উত্তরপ্রত্যুত্তর করিয়া আসর জমাইয়া তুলিবে। কিন্তু এমনি গাম্ভীর্যের ভার তাহার উপর চাপিয়া আসিল যে, লঘু জবাব প্রাণপণ চেষ্টাতেও মুখের কাছে জোগাইল না। বিনোদিনী আজ কেমন একরকম কঠিন দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিতেছে দেখিয়া, মহেন্দ্রের মনটা সবেগে তাহার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল– ব্যবধানটাকে কোনো-একটা নাড়া দিয়া ভূমিসাৎ করিতে ইচ্ছা হইল। বিনোদিনীর শেষ বাক্যঘাতের প্রতিঘাত না দিয়া হঠাৎ তাহার কাছে আসিয়া বসিয়া কহিল, “তুমি আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে কেন। কোনো অপরাধ করিয়াছি?”
বিনোদিনী তখন একটু সরিয়া সেলাই হইতে মুখ তুলিয়া দুই বিশাল উজ্জ্বল চক্ষু মহেন্দ্রের মুখের উপর স্থির রাখিয়া কহিল,