প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
রাইচরণ ম্লান হাস্য করিয়া কহিল, “ মাঠাকরুনকে একবার প্রণাম করিতে চাই। ”
অনুকূল তাহাকে সঙ্গে করিয়া অন্তঃপুরে লইয়া গেলেন। মাঠাকরুন রাইচরণকে তেমন প্রসন্নভাবে সমাদর করিলেন না; রাইচরণ তৎপ্রতি লক্ষ না করিয়া জোড়হস্তে কহিল, “ প্রভু, মা, আমিই তোমাদের ছেলেকে চুরি করিয়া লইয়াছিলাম। পদ্মাও নয়, আর কেহও নয়, কৃতঘ্ন অধম এই আমি — ”
অনুকূল বলিয়া উঠিলেন, “ বলিস কী রে। কোথায় সে। ”
“ আজ্ঞা, আমার কাছেই আছে, আমি পরশ্ব আনিয়া দিব। ”
সেদিন রবিবার, কাছারি নাই। প্রাতঃকাল হইতে স্ত্রীপুরুষ দুইজনে উন্মুখভাবে পথ চাহিয়া বসিয়া আছেন। দশটার সময় ফেল্নাকে সঙ্গে লইয়া রাইচরণ আসিয়া উপস্থিত হইল।
অনুকূলের স্ত্রী কোনো প্রশ্ন কোনো বিচার না করিয়া, তাহাকে কোলে বসাইয়া, তাহাকে স্পর্শ করিয়া, তাহার আঘ্রাণ লইয়া, অতৃপ্তনয়নে তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া, কাঁদিয়া হাসিয়া ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। বাস্তবিক ছেলেটি দেখিতে বেশ — বেশভূষা আকারপ্রকারে দারিদ্র্যের কোনো লক্ষণ নাই। মুখে অত্যন্ত প্রিয়দর্শন বিনীত সলজ্জ ভাব। দেখিয়া অনুকূলের হৃদয়েও সহসা স্নেহ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল।
তথাপি তিনি অবিচলিত ভাব ধারণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ কোনো প্রমাণ আছে? ”
রাইচরণ কহিল, “ এমন কাজের প্রমাণ কী করিয়া থাকিবে। আমি যে তোমার ছেলে চুরি করিয়াছিলাম সে কেবল ভগবান জানেন, পৃথিবীতে আর কেহ জানে না। ”
অনুকূল ভাবিয়া স্থির করিলেন যে, ছেলেটিকে পাইবামাত্র তাঁহার স্ত্রী যেরূপ আগ্রহের সহিত তাহাকে আগলাইয়া ধরিয়াছেন এখন প্রমাণসংগ্রহের চেষ্টা করা সুযুক্তি নহে ; যেমনই হউক, বিশ্বাস করাই ভালো। তা ছাড়া রাইচরণ এমন ছেলেই বা কোথায় পাইবে। এবং বৃদ্ধ ভৃত্য তাঁহাকে অকারণে প্রতারণাই বা কেন করিবে।
ছেলেটির সহিতও কথোপকথন করিয়া জানিলেন যে, সে শিশুকাল হইতে রাইচরণের সহিত আছে এবং রাইচরণকে সে পিতা বলিয়া জানিত, কিন্তু রাইচরণ কখনো তাহার প্রতি পিতার ন্যায় ব্যবহার করে নাই, অনেকটা ভৃত্যের ভাব ছিল।
অনুকূল মন হইতে সন্দেহ দূর করিয়া বলিলেন, “ কিন্তু রাইচরণ, তুই আর আমাদের ছায়া মাড়াইতে পাইবি না। ”
রাইচরণ করজোড়ে গদ্গদ কণ্ঠে বলিল, “ প্রভু বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাইব। ”
কর্ত্রী বলিলেন, “ আহা, থাক্। আমার বাছার কল্যাণ হউক। ওকে আমি মাপ করিলাম। ”
ন্যায়পরায়ণ অনুকূল কহিলেন, “ যে কাজ করিয়াছে উহাকে মাপ করা যায় না। ”
রাইচরণ অনুকুলের পা জড়াইয়া কহিল, “ আমি করি নাই, ঈশ্বর করিয়াছেন। ”
নিজের পাপ ঈশ্বরের স্কন্ধে চাপাইবার চেষ্টা দেখিয়া অনুকূল আরো বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “ যে এমন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করিয়াছে তাহাকে আর বিশ্বাস করা কর্তব্য নয়। ”
রাইচরণ প্রভুর পা ছাড়িয়া কহিল, “ সে আমি নয়, প্রভু। ”
“ তবে কে। ”
“ আমার অদৃষ্ট। ”
কিন্তু এরূপ বৈফিয়তে কোনো শিক্ষিত লোকের সন্তোষ হইতে পারে না।