প্রজাপতির নির্বন্ধ

চন্দ্রবাবু নিজের দক্ষিণ করতল চোখের অত্যন্ত কাছে লইয়া নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। পূর্ণ খুব চমৎকার করিয়া একটা কিছু বলিবার ইচ্ছা করিল, কিন্তু তাহার মুখ দিয়া কোনো কথাই বাহির হইল না। নির্মলা দ্বারের অন্তরালে থাকিলে পূর্ণর বাক্‌শক্তি যেরূপ সতেজ থাকে আজ তাহার তেমন পরিচয় পাওয়া গেল না।

তবু সে মনে মনে অনেক আবৃত্তি করিয়া বলিল, “দেবী, এই পঙ্কিল পৃথিবীর কাজে কেন আপনার পবিত্র দুইখানি হস্ত প্রয়োগ করিতে চাচ্ছেন?”

কথাটা মনে যেমন লাগিতেছিল মুখে তেমন শোনাইল না– পূর্ণ বলিয়াই বুঝিতে পারিল কথাটা গদ্যের মধ্যে হঠাৎ পদ্যের মতো কিছু যেন বাড়াবাড়ি হইয়া পড়িল। লজ্জায় তাহার কান লাল হইয়া উঠিল। বিপিন স্বাভাবিক সুগম্ভীর শান্তস্বরে কহিল, “পৃথিবী যত বেশি পঙ্কিল পৃথিবীর সংশোধন-কার্য তত বেশি পবিত্র।”

এই কথাটায় কৃতজ্ঞ নির্মলার মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া পূর্ণ ভাবিল, ‘আহা, কথাটা আমারই বলা উচিত ছিল।’
বিপিন বলিয়াছে বলিয়া তাহার উপর অত্যন্ত রাগ হইল।

শ্রীশ। সভার অধিবেশনে স্ত্রীসভ্য লওয়া সম্বন্ধে নিয়মমত প্রস্তাব উত্থাপন করে যা স্থির হয় আপনাকে জানাব।

নির্মলা এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করিয়া পালের নৌকার মতো নিঃশব্দে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল। হঠাৎ অধ্যাপক সচেতন হইয়া ডাকিলেন, “ফেনি, আমার সেই গলার বোতামটা?”

নির্মলা সলজ্জ হাসিয়া মুদুকণ্ঠে ইশারা করিয়া কহিল, “গলাতেই আছে।”

চন্দ্রবাবু গলায় হাত দিয়া “হাঁ হাঁ আছে বটে” বলিয়া তিন ছাত্রের দিকে চাহিয়া হাসিলেন।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

নৃপবালা। আজকাল তুই মাঝে মাঝে কেন অমন গম্ভীর হচ্ছিস বল্‌ তো নীরু।

নীরবালা। আমাদের বাড়ির যত কিছু গাম্ভীর্য সব বুঝি তোর একলার? আমার খুশি আমি গম্ভীর হব।

নৃপবালা। তুই কী ভাবছিস আমি বেশ জানি।

নীরবালা। তোর অত আন্দাজ করবার দরকার কী ভাই? এখন তোর নিজের ভাবনা ভাববার সময় হয়েছে।

নৃপ নীরুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “তুই ভাবছিস, মা গো মা, আমরা কী জঞ্জাল। আমাদের বিদায় করে দিতেও এত ভাবনা, এত ঝঞ্ঝাট।”

নীরবালা। তা, আমরা তো ভাই ফেলে দেবার জিনিস নয় যে অমনি ছেড়ে দিলেই হল। আমাদের জন্যে যে এতটা হাঙ্গাম হচ্ছে সে তো গৌরবের কথা। কুমারসম্ভবে তো পড়েছিস গৌরীর বিয়ের জন্য একটি আস্ত দেবতা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। যদি কোনো কবির কানে উঠে তা হলে আমাদের বিবাহেরও একটা বর্ণনা বেরিয়ে যাবে।

নৃপবালা। না ভাই, আমার ভারি লজ্জা করছে।

নীরবালা। আর, আমার বুঝি লজ্জা করছে না? আমি বুঝি বেহায়া? কিন্তু কী করবি বল্‌? ইস্কুলে যেদিন প্রাইজ নিতে গিয়েছিলুম লজ্জা করেছিল, আবার তার পর বছরেও প্রাইজ নেবার জন্যে রাত জেগে পড়া মুখস্থ করেছিলেম। লজ্জাও করে প্রাইজও ছাড়ি নে, আমার এই স্বভাব।

নৃপবালা। আচ্ছা নীরু, এবারে যে প্রাইজটার কথা চলছে সেটার জন্য তুই কি খুব ব্যস্ত হয়েছিস?