বাঁশরি

সুষমা। জানি বৈকি। এই সেদিন পড়ছিলুম ওঁর ‘বোকার বুদ্ধি’ গল্পটা। কাগজে কেন এত গাল দিয়েছে বুঝতে পারলুম না।

ক্ষিতিশ। অর্থাৎ বইখানা গাল দেবার যোগ্য এতই কী ভালো।

সুষমা। ওরকম ধারালো কথা বলবার ভার বাঁশরি আর ঐ আমার পিসতুতো বোন লীলার উপরে। আপনাদের মতো লেখকের বই সমালোচনা করতে ভয় করি, কেননা তাতে সমালোচনা করা হয় নিজেরই বিদ্যে-বুদ্ধির। অনেক কথা বুঝতেই পারি নে। বাঁশরির কল্যাণে আপনাকে কাছে পেয়েছি, দরকার হলে বুঝিয়ে নেব।

বাঁশরি। ক্ষিতিশবাবু ন্যাচারল্‌ হিস্ট্রী লেখেন গল্পের ছাঁচে। যেখানটা জানা নেই, দগদগে রঙ লেপে দেন মোটা তুলি দিয়ে। রঙের আমদানি সমুদ্রের ওপার থেকে। দেখে দয়া হল। বললুম, জীবজন্তুর সাইকলজির খোঁজে গুহাগহ্বরে যেতে যদি খরচে না কুলোয়, অন্তত জুয়োলজিকালের খাঁচার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে দোষ কী।

সুষমা। তাই বুঝি এনেছ এখানে?

বাঁশরি। পাপমুখে বলব কী করে। তাই তো বটে। ক্ষিতিশবাবুর হাত পাকা, মালমশলাও পাকা হওয়া চাই। যথাসাধ্য জোগাড় দেবার মজুরগিরি করছি।

সুষমা। ক্ষিতিশবাবু, একটু অবকাশ করে নিয়ে আমাদের ওদিকে যাবেন। মেয়েরা সদ্য আপনার বই কিনে আনিয়েছে সই নেবে বলে। সাহস করছে না কাছে আসতে। বাঁশি, ওঁকে একলা ঘিরে রেখে কেন অভিশাপ কুড়োচ্ছ।

বাঁশরি। (উচ্চহাস্যে) সেই অভিশাপই তো মেয়েদের বর। সে তুমি জান। জয়যাত্রায় মেয়েদের লুটের মাল প্রতিবেশিনীর ঈর্ষা।

সুষমা। ক্ষিতিশবাবু, শেষ দরবার জানিয়ে গেলুম। গণ্ডি পেরোবার স্বাধীনতা যদি থাকে একবার যাবেন ওদিকে।

[ সুষমার প্রস্থান

ক্ষিতিশ। কী আশ্চর্য ওঁকে দেখতে। বাঙালি ঘরের মেয়ে বলে মনেই হয় না। যেন এথীনা, যেন মিনর্ভা, যেন ব্রুন্‌‍হিল্‌ড্‌।

বাঁশরি। (তীব্রহাস্যে) হায় রে হায়, যত বড়ো দিগ্‌গজ পুরুষই হোক-না কেন সবার মধ্যেই আছে আদিম যুগের বর্বর। হাড়-পাকা রিয়লিস্ট বলে দেমাক কর, ভান কর মন্তর মান না। লাগল মন্তর চোখের কটাক্ষে, একদম উড়িয়ে নিয়ে গেল মাইথলজির যুগে। আজও কচি মনটা রূপকথা আঁকড়িয়ে আছে। তাকে হিঁচড়িয়ে উজোন পথে টানাটানি করে মনের উপরের চামড়াটাকে করে তুলেছ কড়া। দুর্বল বলেই বলের এত বড়াই।

ক্ষিতিশ। সে কথা মাথা হেঁট করেই মানব। পুরুষজাত দুর্বল জাত।

বাঁশরি। তোমরা আবার রিয়লিস্‌ট্‌! রিয়লিস্‌ট্‌ মেয়েরা। যতবড়ো স্থূল পদার্থ হও না, যা তোমরা তাই বলেই জানি তোমাদের। পাঁকে-ডোবা জলহস্তীকে নিয়ে ঘর যদি করতেই হয় তাকে ঐরাবত বলে রোমান্স্‌ বানাই নে। রঙ মাখাই নে তোমাদের মুখে। মাখি নিজে। রূপকথার খোকা সব! ভালো কাজ হয়েছে মেয়েদের! তোমাদের ভোলানো। পোড়া কপাল আমাদের! এথীনা! মিনর্ভা! মরে যাই! ওগো রিয়লিস্‌ট্‌, রাস্তায় চলতে যাদের দেখেছ পানওয়ালীর দোকানে, গড়েছ কালো মাটির তাল দিয়ে যাদের মূর্তি, তারাই সেজে বেড়াচ্ছে এথীনা, মিনর্ভা।

ক্ষিতিশ। বাঁশি, বৈদিককালে ঋষিদের কাজ ছিল মন্তর পড়ে দেবতা ভোলানো–যাঁদের ভোলাতেন তাঁদের ভক্তিও করতেন। তোমাদের যে সেই দশা। বোকা পুরুষদের ভোলাও তোমরা, আবার পাদোদক নিতেও ছাড় না। এমনি করেই মাটি করলে এই জাতটাকে।

বাঁশরি। সত্যি সত্যি, খুব সত্যি। ঐ বোকাদের আমরাই বসাই টঙের উপরে, চোখের জলে কাদামাখা পা ধুইয়ে দিই, নিজেদের অপমানের শেষ করি, যত ভোলাই তার চেয়ে ভুলি হাজার গুণে।