যোগাযোগ

খানিক পরে নবীন বললে, “আপনার অনুমতি পেলেই ওঁকে নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করি।”

ইতিমধ্যে কুমু ধীরে ধীরে দাদার পায়ের কাছে এসে বসেছে। বিপ্রদাস তার মুখের উপর দৃষ্টি রেখে বললে, “মনে যদি করিস তোর যাবার সময় হয়েছে তা হলে যা কুমু।”

কুমু বললে, “না দাদা, যাব না।” বলে বিপ্রদাসের হাঁটুর উপর উপুড় হয়ে পড়ল।

ঘর স্তব্ধ, কেবল থেকে থেকে দমকা বাতাসে একটা শিথিল জানলা খড়্‌ খড়্‌ করছে, আর বাইরে বাগানে গাছের পাতাগুলো মর্মরিয়ে উঠছে। কুমু একটু পরে বিছানা থেকে উঠেই নবীনকে বললে, “চলো আর দেরি নয়। দাদা, তুমি ঘুমোও।”

মোতির মা বাড়িতে ফিরে এসে বললে, “এতটা কিন্তু ভালো না।”

“অর্থাৎ চোখে খোঁচা দেওয়াটা যেমনি হোক-না, চোখটা রাঙা হয়ে ওঠা একেবারেই ভালো নয়।”

“না গো না, ওটা ওঁদের দেমাক। সংসারে ওঁদের যোগ্য কিছুই মেলে না, ওঁরা সবার উপরে।”

“মেজোবউ, এতবড়ো দেমাক সবাইকে সাজে না, কিন্তু ওঁদের কথা আলাদা।”

“তাই বলে কি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি করতে হবে!”

“আত্মীয়স্বজন বললেই আত্মীয়স্বজন হয় না। ওঁরা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আর-এক শ্রেণীর মানুষ। সম্পর্ক ধরে ওঁদের সঙ্গে ব্যবহার করতে আমার সংকোচ হয়।”

“যিনি যতবড়ো লোকই হোন-না কেন, তবু সম্পর্কের জোর আছে এটা মনে রেখো।”

নবীন বুঝতে পারলে এই আলোচনার মধ্যে কুমুর ’পরে মোতির মা’র একটুখানি ঈর্ষার ঝাঁজও আছে। তা ছাড়া এটাও সত্যি, পারিবারিক বাঁধনটার দাম মেয়েদের কাছে খুবই বেশি। তাই নবীন এ নিয়ে বৃথা তর্ক না করে বললে, “আর কিছুদিন দেখাই যাক-না। দাদার আগ্রহটাও একটু বেড়ে উঠুক, তাতে ক্ষতি হবে না।”


৫৩

মধুসূদনের সংসারে তার স্থানটা পাকা হয়েছে বলেই শ্যামাসুন্দরী প্রত্যাশা করতে পারত, কিন্তু সে কথা অনুভব করতে পারছে না। বাড়ির চাকরবাকরদের ’পরে ওর কর্তৃত্বের দাবি জন্মেছে বলে প্রথমটা ও মনে করেছিল, কিন্তু পদে পদে বুঝতে পারছে যে তারা ওকে মনে মনে প্রভুপদে বসাতে রাজি নয়। ওকে সাহস করে প্রকাশ্যে অবজ্ঞা দেখাতে পারলে তারা যেন বাঁচে এমনি অবস্থা। সেইজন্যেই শ্যামা তাদেরকে যখন-তখন অনাবশ্যক ভর্ৎসনা ও অকারণে ফরমাশ করে কেবলই তাদের দোষত্রুটি ধরে। খিট্‌ খিট্‌ করে। বাপ মা তুলে গাল দেয়। কিছুদিন পূর্বে এই বাড়িতেই শ্যামা নগণ্য ছিল, সেই স্মৃতিটাকে সংসার থেকে মূছে ফেলবার জন্যে খুব কড়াভাবে মাজাঘষার কাজ করতে গিয়ে দেখে যে সেটা সয় না। বাড়ির একজন পুরোনো চাকর শ্যামার তর্জন না সইতে পেরে কাজে ইস্তফা দিলে। তাই নিয়ে শ্যামাকে মাথা হেঁট করতে হল। তার কারণ, নিজের ধনভাগ্য সম্বন্ধে মধুসূদনের কতকগুলো অন্ধ সংস্কার আছে। যে-সব চাকর তার আর্থিক উন্নতির সমকালবর্তী, তাদের মৃত্যু বা পদত্যাগকে ও দুর্লক্ষণ মনে করে। অনুরূপ কারণেই সেই সময়কার একটা মসীচিহ্নিত অত্যন্ত পুরোনো ডেক্স অসংগতভাবে আপিসঘরে হাল আমলের দামি আসবাবের মাঝখানেই অসংকোচে প্রতিষ্ঠিত আছে, তার উপরে সেই সেদিনকারই দস্তার দোয়াত আর-একটা সস্তা বিলিতি কাঠের কলম,যে কলমে সে তার ব্যাবসায়ের নবযুগে প্রথম বড়ো একটা দলিলে নাম সই করেছিল। সেই সময়কার উড়ে চাকর দধি যখন কাজে জবাব দিলে মধুসূদন সেটা গ্রাহ্যই করলে না, উলটে সে লোকটার ভাগ্যে বকশিশ জুটে গেল। শ্যামাসুন্দরী এই নিয়ে ঘোরতর অভিমান করতে গিয়ে দেখে