যোগাযোগ
ঘরে ঢুকে একধারে নতনেত্রে দাঁড়িয়ে রইল। মধুসূদন ডাকলে, “এসো, এইখানে এসো, বসো।”

শ্যামা শিয়রের কাছে বসে “তোমাকে যে বড়ো রোগা দেখাচ্ছে আজ” বলে একটু ঝুঁকে পড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

মধুসূদন বললে, “আঃ, তোমার হাত বেশ ঠাণ্ডা।”

রাত্রে মধুসূদন যখন শুতে এল শ্যামাসুন্দরী অনাহূত ঘরে ঢুকে বললে, “আহা, তুমি একলা।”

শ্যামাসুন্দরী একটু যেন স্পর্ধার সঙ্গেই কোনো আর আবরণ রাখতে দিলে না। যেন অসংকোচে সবাইকে সাক্ষী রেখেই ও আপনার অধিকার পাকা করে তুলতে চায়। সময় বেশি নেই, কবে আবার কুমু এসে পড়বে, তার মধ্যে দখল সম্পূর্ণ হওয়া চাই। দখলটা প্রকাশ্য হলে তার জোর আছে, কোনোখানে লজ্জা রাখলে চলবে না। অবস্থাটা দেখতে দেখতে দাসীচাকরদের মধ্যেও জানাজানি হল। মধুসূদনের মনে বহুকালের প্রবৃত্তির আগুন যতবড়ো জোরে চাপা ছিল, ততবড়ো জোরেই তা অবারিত হল, কাউকে কেয়ার করলে না; মত্ততা খুব স্থূলভাবেই সংসারে প্রকাশ করে দিলে।

নবীন মোতির মা দুজনেই বুঝলে এ বান আর ঠেকানো যাবে না।

“দিদিকে কি ডেকে আনবে না? আর কি দেরি করা ভালো?”

“সেই কথাই তো ভাবছি। দাদার হুকুম নইলে তো উপায় নেই। দেখি চেষ্টা করে।”

যেদিন সকালে কৌশলে দাদার কাছে কথাটা পাড়বে বলে নবীন এল, দেখে যে দাদা বেরোবার জন্য প্রস্তুত, দরজার কাছে গাড়ি তৈরি।

নবীন জিজ্ঞাসা করলে, “কোথাও বেরোচ্ছ নাকি?”

মধুসূদন একটু সংকোচ কাটিয়ে বললে, “সেই গনৎকার বেঙ্কটস্বামীর কাছে।”

নবীনের কাছে দুর্বলতা চাপা রাখতেই চেয়েছিল। হঠাৎ মনে হল ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলেই সুবিধা হতে পারে। তাই বললে, “চলো আমার সঙ্গে।”

নবীন ভাবলে, সর্বনাশ। বললে, “দেখে আসি গে সে বাড়িতে আছে কিনা। আমার তো বোধ হচ্ছে সে দেশে চলে গেছে, অন্তত সেইরকম তো কথা।”

মধূসূদন বললে, “তা বেশ তো, দেখে আসা যাক-না।”

নবীন নিরুপায় হয়ে সঙ্গে চলল, কিন্তু মনে মনে প্রমাদ গনলে।

গনৎকারের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই নবীন তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে একটু উঁকি মেরেই বললে, “বোধ হচ্ছে কেউ যেন বাড়িতে নেই।”

যেমন বলা, সেই মুহূর্তেই স্বয়ং বেঙ্কটস্বামী দাঁতন চিবোতে চিবোতে দরজার কাছে বেরিয়ে এল। নবীন দ্রুত তার গা ঘেঁষে প্রণাম করে বললে, “সাবধানে কথা কবেন।”

সেই এঁদো ঘরে তক্তপোশে সবাই বসল। নবীন বসল মধুসূদনের পিছনে। মধুসূদন কিছু বলবার আগেই নবীন বলে বসল, “মহারাজের সময় বড়ো খারাপ যাচ্ছে, কবে গ্রহশান্তি হবে বলে দাও শাস্ত্রীজি।”

মধুসূদন নবীনের এই ফাঁস-করে-দেওয়া প্রশ্নে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে তার ঊরুতে খুব একটা টিপনি দিলে।

বেঙ্কটস্বামী রাশিচক্র কেটে একেবারে স্পষ্টই দেখিয়ে দিলে মধুসূদনের ধনস্থানে শনির দৃষ্টি পড়েছে।

গ্রহের নাম জেনে মধুসূদনের কোনো লাভ নেই, তার সঙ্গে বোঝাপড়া করা শক্ত। যে যে মানুষ ওর সঙ্গে শত্রুতা করছে স্পষ্ট করে তাদেরই পরিচয় চাই, বর্ণমালার যে বর্গেই পড়ুক নাম বের করতে হবে। নবীনের মুশকিল এই যে, সে মধুসূদনের আপিসের