ললাটের লিখন

বললে, “ পুরুষ বলেই বুঝতে পারছেন না, ভালোবাসা নইলে দুজন মানুষকে সম্পুর্ণ করে মেলানো যায় না। ”

“ মেয়ে বলেই বুঝতে চাইছ না যে, প্রেমের মিলন ভালোবাসার চেয়ে সত্য, তাতে মোহের মিশেল নেই। ”

“ সন্ন্যাসী, তুমি জান না মানুষকে। তার হৃদয়গ্রনিথ জোর করে টেনে ছিঁড়ে সেই জায়গায় তোমার নিজের আইডিয়ার গ্রন্থি জুড়ে দিয়ে অসহ্য ব্যাথার 'পরে বড়ো বড়ো বিশেষণ চাপা দিতে চাও। গ্রন্থি টিকবে না। ব্যাথাই যাবে থেকে। মানুষের লোকালয়ে তোমরা এলে কী করতে — যাও-না তোমাদের গুহার গহ্বরে বদরিকাশ্রমে — সেখানে মনের সাধে নিজেদের শুকিয়ে মারতে চাও মারো, আমরা সামান্য মানুষ আমাদের তৃষ্ণার জল মুখের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মরুভুমিতে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে সাধনা বলে প্রচার করতে এলে কোন্‌ করুণায়? আমাদের অভিশাপ লাগবে না তোমাকে? যা তুমি নিজে ভোগ করতে জান না তা তুমি ভোগ করতে দেবে না ক্ষুধিতকে?

“ এই যে সুষমা, শোনো বলি, মেয়েরা চিতার আগুনে মরেছে অনেকে, ভেবেছে তাতেই পরমার্থ। তেমনি করে দিনে দিনে মরতে চাও জ্বলে — চাও না তুমি ভালোবাসা। কিন্তু যে চায়, পাষাণ করে নি যে আপন নারীর প্রাণ, কেন কেড়ে নিতে এলে তার চিরজীবনের সুখ। এই আমি আজ বলে দিলুম তোমাকে, ঘোড়ায় চড়ো, শিকার করো যাই কর, তুমি পুরুষ নও, আইডিয়ার সঙ্গে গাঁঠছড়া বেঁধে তোমার দিন কাটবে না গো, তোমার রাত বিছিয়ে দেবে কাঁটার শয়ন। ”

বাঁশরির উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনে বাইরে থেকে তাড়াতাড়ি এল সোমশংকর। বললে, “ বাঁশি, শান্ত হও, চলো এখান থেকে। ”

“ যাব না তো কী। মনে কোরো না বুক ফেটে মরব, জীবন হয়ে থাকবে চির-চিতানলের শ্মশান। কখনো আমার এমন বিচলিত দশা হয় নি — আজ কেন বন্যার মতো এল এই পাগলামি! লজ্জা, লজ্জা, লজ্জা — তোমাদের তিনজনের সামনেই এই অপমান। মুছে ফেলব লজ্জা, এর চিহ্ন থাকবে না। চললুম। ”

 

সন্ধেবেলায় কোনো একটা উপলক্ষে সানাই বাজছে সুষমাদের বাড়িতে। বাঁশরি তখন তার একলা বাড়ির কোণের ঘরে বসে পড়ছে একটা খাতা নিয়ে। শেষ হয়ে গেছে পৃথ্বীশের লেখা গল্প। নাম তার, ‘ভালোবাসার নীলাম'।

নায়িকা পঙ্কজা কেমন করে অর্থলোভে দিনে দিনে সার চন্দ্রশেখরের মন ভুলিয়ে তাকে আয়ত্ত করলে তার খুব একটা টকটকে ছবি, সুনিপুণ তন্নতন্ন তার বিবরণ। দুই নম্বরের নায়িকা দীপিকা নির্বোধকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করছে প্রাণপণে, শেষকালে কী অসহ্য ঘৃণা, কী বুকফাটা কান্না। ছুটে বেরোলে আত্মহত্যা করতে, শীতকালে জলে পা দিতে গিয়েই হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে শীত করে উঠল, কিংবা হঠাৎ মনে সংকল্প এল বেঁচে থেকেই শেষ পর্যন্ত ওদের দুজনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে। দ্বিধার এই দুটো কারণের মধ্যে কোন্‌টা সত্য সেটা কৌশলে অনিশ্চিত রাখা হয়েছে।

পৃথ্বীশ কখন এক সময় পা টিপে টিপে একটা চেয়ারে এসে বসেছে পিছন দিকে। বাঁশরি জানতে পারে নি। পড়া হয়ে যেতেই বাঁশরি খাতাখানা যখন ধপ করে ফেললে টেবিলের উপর — পৃথ্বীশ সামনে এসে বললে, “ কেমন লাগল। মেলোড্রামার খাদ মিশোই নি এক তোলাও। সেন্টিমেন্টালিটির তরল রস চায় যারা তাদের পক্ষে নির্জলা একাদশী ; একেবারে নিষ্ঠুর সত্য। ”

বাঁশরি বললে, “ কেমন লাগল? এই দেখিয়ে দিচ্ছি। ” বলে পাতাগুলো ছিঁড়তে লাগল একটার পর একটা। পৃথ্বীশ বললে, “ করলে কী? আমার সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ লেখা নষ্ট করলে, তা জান। ”

“ কী দাম চাই? ”

“ তোমাকে। ”